হুমায়ূন আজাদ- এর ‘নারী’ কেন নিষিদ্ধ? এই বিষয় নিয়ে কথা বলা, বেশ কঠিন বিষয় আবার একিই সাথে সহজ বিষয়। যখন কোন বিষয় নিয়ে খুব সহজে কথা বলার পর; সেই বিষয়ের গ্রহণযোগ্যতার ওপর পুনঃ পুনঃ প্রশ্ন উঠে আসে তখনিই বিষয়টা পুনঃবার বোঝানো বেশ কঠিন হয়ে যায়। আর হুমায়ূন আজাদ- এর ” নারী ” গ্রন্থটি এমনই এক গ্রন্থ। এবং বইটি প্রথমে ১৯৯২ সালে ঢাকায় একুশে বইমেলাতে প্রকাশিত হয়।
এরপর, ধর্মানুভুতিতে আঘাতের দায়ে ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কতৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর, আবার ২০০০ সালে সেই নিষিদ্ধ আদেশকে বাতিল করে উচ্চ আদালত। প্রায় সাড়ে চার বছর পর আবার পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে ” নারী ” বইটি অগ্রণী প্রকাশনি থেকে।
হুমায়ূন আজাদ- এর ‘নারী’ বই এর মূল আলোচনা
হুমায়ূন আজাদের ” নারী ” বইয়ের মূল আলোচনা হল সমাজে নারী জাতির আসল অবস্থান এবং কিভাবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে ব্যবহার করা হচ্ছে শুধুমাত্র পুরুষের পরিপূরক সত্তা বলে। বইটিতে হুমায়ূন আজাদ আলোচনা করেছেন বিভিন্ন নারীবাদী দর্শনের ভিত্তিতে। লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর একান্ত মতবাদ।
দেখাতে চেয়েছেন বিভিন্ন তথাকথিত নারীবাদীরাও নারীদের মূল সর্বনাশ এবং তাঁদের মানুষ হিসেবে অধিকার নিয়ে একটুও ভাবেন না। এবং, নারীরা কিভাবে পুরুষের ছলনায় তথাকথিত জীবনসঙ্গী হতে গিয়ে শুধুমাত্র পুরুষের করায়ত্তেই থেকে গেছেন। হুমায়ন আজাদ তাঁর বক্তব্য গুলোকে বিভিন্ন অধ্যায়ে ভাগ করেছেন আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরার জন্যে।
আলোচনা এবং সমালচনা করেছেন নারীদের এই দুর্দশার কারণ হাওয়া বিভিন্ন সাহিত্যিক এর। ” নারী ” হুমায়ূন আজাদের লেখা একটি নারীবাদী রচনার বই, যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নারীবাদ বিষয়ক বই। এই বইটিতে আছে মোট ২১টি অধ্যায় এবং তৃতীয় সংস্করণে আছে মোট ৪০৮ পৃষ্ঠা। এবং, নারীবাদ ও নারীবাদের কালপঞ্জি, রচনাপঞ্জি, নির্ঘন্ট সহ মোট ২৪টি অধ্যায়।
হুমায়ূন আজাদ- এর ‘নারী’ বই এর অধ্যায়ের নামগুলো
হুমায়ূন আজাদ এর ” নারী ” বই এর অধ্যায়গুলোর নাম জেনে নেয়া উচিত। কারণ, তাতে করে হয়তো তখনকার সময় এই বইটি কেন নিষিদ্ধ হয়েচিল তা বোঝা সহজ হবে। নিচে ” নারী ” বই এর অধ্যায়ের নামগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হল।
১। নারী ও তার বিধাতা, ২। লৈঙ্গিক রাজনীতি, ৩। দেবী ও দানবী, ৪। নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়, ৫। পিতৃতন্ত্রের খড়গ, ৬। নারীর শত্রুমিত্র, ৭। ফ্রয়েডীয় কুসংস্কার, ও মনোবিশ্লেষাণাত্মক-সমাজবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীলতা, ৮। নারী, তার লিঙ্গ ও শরীর, ৯। বালিকা, ১০। কিশোরীতরুণী, ১১। নষ্টনীড়, ১২। প্রেম ও কাম, ১৩। বিয়ে ও সংসার, ১৪। ধর্ষণ, ১৫। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট, ১৬। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর, ১৭। পুরুষতন্ত্র ও রোকেয়ার নারীবাদ, ১৮। বঙ্গীয় ভদ্রমহিলা, ১৯। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা, ২০। নারীদের নারীরা, ২১। নারীর ভবিষ্যৎ।
এই ২১টি হল হুমায়ূন আজাদের ” নারী ” বই- এর অধ্যায়সমুহ। আর, এই অধ্যায়গুলোতে তৎকালীন এবং বর্তমান পৃথিবীতে কীভাবে নারীদের শুধুমাত্র পরিপূরক লিঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কোন নিজস্ব সত্তা হিসেবে নয়। বইটি পাঠোদ্ধার করা বেশ কঠিন এবং এই কারণেই বেশ সমালোচনার মুখমুখি হতে হয়েছে। অনেকে এই বইটিকে বলেছেন নারী সত্তার অপমান, কেও বলেছেন পুরুষবিদ্বেষী, কেও আবার বলেছেন ধর্ম ও নৈতিকতার বিরোধী।
অথচ, এক্ষেত্রে লেখক হুমায়ূন আজাদ বলেছেন ” নারী- বইটি পুরুষবিদ্বেষী নয়; তবে পুরুষতন্ত্রবাদী পুরুষের সমালোচনায় মুখর। ”
ঠিক কোন কারণে ‘ নারী ‘ বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল?
খুব সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়; হুমায়ূন আজাদের ” নারী ” বইটি নিষিদ্ধ হওয়ার কোন যথাযথ কারণ ছিলনা। তবুও, তৎকালীন ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিরাজ করতো তা অনেকক্ষানি মৌলবাদ কেন্দ্রিক এবং মূলত মৌলবাদের পুরুষতান্ত্রিক রোষানলে পড়ে নিষিদ্ধ হয়েছিল হুমায়ূন আজাদের ” নারী “।
বইটি নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রে দেখা যায়; ” নারী ” বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য বইটি থেকে মাত্র ১৪টি বাক্য উদ্ধৃতি দিয়ে; সাথে দ্বীনি দাওয়াত ও সংস্কৃতি বিভাগ, এবং ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুটি বিশেষজ্ঞ থেকে জুড়ে দেয়া হয় দুই পাতার সুপারিশ। এবং এই নিষিদ্ধকরণের আদেশপত্রে যে সহকারী সচিব স্বাক্ষর করেছিলেন, তিনি নিজেই একজন নারী ছিলেন।
ঘটনাটিকে বলা যায়, এই স্বাধীন বাংলাদেশে নারী কর্তৃক নারী সত্তাকে হত্যা! যদিও পরবর্তীতে বইটির নিষিদ্ধ করণের আদেশ বাতিল হয়েছিল। আর, ১৯৯৫ এর ১৯ নভেম্বরের সেই নিষিদ্ধকরণের আদেশপত্রে বলা হয় ” পুস্তকটিতে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি তথা মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী আপত্তিকর বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় সরকার কর্তৃক ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ ‘ক’ ধারার ক্ষমতাবলে বর্ণিত পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত হইল।”
এই নিষিদ্ধকরণের পরিপ্রেক্ষিতে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন; ” এত বড় বই পড়ার শক্তি ওই দুই মৌলবাদীর ছিল না; তারা বইটি থেকে কয়েকটি বাক্য তুলে পরামর্শ দেয় নিষিদ্ধ করার। ”
আর তাই, উপর্যুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, হুমায়ূন আজাদের ” নারী ” বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল শুধুমাত্র পুরুষতন্ত্রী মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য।
আশা করি, যারা নিবন্ধটি পড়েছেন, খুব সহজেই বুঝতে পেরেছেন কেন হুমায়ূন আজাদ- এর ‘নারী’ বইটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যদি এমন আরও নিবন্ধ পড়তে ইচ্ছুক তবে আপনি আরও পড়তে পারেন প্রথম সার্থক উপন্যাস ” দুর্গেশনন্দিনী ” সম্বন্ধে।
Leave a Reply