বাংলা শাস্ত্রীয় সংগীতে নজরুল একজন ক্ষণজন্মা ধূমকেতু। হঠাৎ এসে আকাশটাকে একটু আলোকিত করে মিশে যাওয়া এক ধূমকেতু। আজকের এই নিবন্ধে আমরা জানবো বাংলা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর অবদান সম্বন্ধে।
সঙ্গীতের যতগুলো শাখা রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো এবং গুরুত্বপূর্ণ সতন্ত্র সংগীত হল শাস্ত্রীয় সংগীত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Classical music. পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে শাস্ত্রীয় সংগীত এর ধারা বিভিন্ন রকম।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ২ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা হয়ে আসছে। এর মধ্যে অনেক সংগীতজ্ঞের পদার্পণ হয়েছে এই উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের বাহিরে থেকে প্রবেশ করেছেন এবং তৈরি করেছেন ছোট্ট এক নজরুল জগৎ।
শাস্ত্রীয় সংগীত সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
বাংলা শাস্ত্রীয় সংগীতে নজরুল এর ভুমিকা বা অবদান জানতে হলে প্রথমেই আগে জানতে হবে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত সম্পর্কে। আর আগেই বলে রাখি; শাস্ত্রীয় সাঙ্গেএত নিয়ে কথা বলতে গেলে পুরো একটি বইয়েও শেষ হবেনা। আর এই খানে শুধু ছোট্ট করে কিছু কথা বলে নেয়া দরকার, তাছাড়া মূল জ্ঞাতব্যের বিষয়বস্তু একটু অনর্থক মনে হবে।
রাগ, খেয়াল, ধুন, ইত্যাদি সঙ্গীতকে শাস্ত্রীয় সংগীত বলা হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিবেশনা করা হয় মূলত দুটি উপায়ে। যথাঃ বাদ্যযন্ত্রে, কণ্ঠে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুটি মৌলিক উপাদান রয়েছে যা রাগ ও তাল হিসেবে আমাদের সবার কাছে পরিচিত। রাগ ২২ টি শ্রুতির সমন্বয়ে সৃষ্টি এবং সাতটি সুর সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি সমন্বয়ে সৃষ্টি।
- শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রধান শাখাগুলো হলঃ ধ্রুপদ,তারানা ও খেয়াল।
- অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শাখাগুলো হলঃ ঠুংরি, গজল, কাজরি, ভজন, টপ্পা ইত্যাদি।
শাস্ত্রীয় সংগীতে নজরুলের অবদান
বাংলা শাস্ত্রীয় সংগীতে নজরুলের গান গুলোকে নজরুলগীতি বলা হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সুরকার, গীতিকার এবং শিল্পীও ছিলেন। বাংলা শাস্ত্রীয় সংগীতে নজরুল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি শ্যামা সঙ্গীত এবং ইসলামী সঙ্গীতের সুরকার ও গীতিকার ছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম ১০ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ, দেশাত্মবোধক গান এবং কীর্তনের উপর ভিত্তি করে প্রায় ৮০০ টির ও বেশি গান লিখেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে এবং বাংলা সঙ্গীতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ১৯৪৫ সালে তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিনী স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়।
কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত অনেক শাস্ত্রীয় সঙ্গীত রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলঃ অরুনকান্তি কে গো, প্রথম প্রদীপ, ভরিয়া পরান, শূন্য এ বুকে, পরদেশী মেঘ যাও, পিউ পিউ বিরোহি, বসন্ত মুখরা, সন্ধ্যা গোধূলি, রিমঝিম রিমঝিম, অচেতন মন, মেঘ মেদুর, সৃজন চান্দে, আজও কান্দ কাননে, স্নিগ্ধা শ্যাম, সই ভালো করে, চৈতালি চাঁদিনী, আজও মধুর, এসো প্রিয় আরও, মোর না মিটিতে আশা ইত্যাদি।
এছাড়াও কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক প্রণয়ধর্মী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত রয়েছে । সেগুলো হলঃ দাঁড়ালে দুয়ারে মোর, নয়ন ভরা জল গো তোমার, কেমনে রাখি আখেবারি, ছোলো ছোলো নয়নে মোর, এতো জল ও কাজল চোখে, নহে নহে প্রিয় এ নয় আখিজাল, এ আখিজল মোছো প্রিয়, চোখ মুছিলেই জল মোছেনা, জনম জনম গেলো, আখিবারি আঁখিতে থাক ইত্যাদি।
কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামী সঙ্গীতে অনেক অবদান রেখেছেন। সেগুলো হলঃ তাওহীদেরই মুর্শিদ আমার, এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল, হেরা হতে হেলে দুলে, শোনো শোনো ইয়া এলাহি, মসজিদেরই পাশে আমায়,তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে, রোজ হাসরে আল্লাহ আমার, ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ, হে নামাজী আল্লাহর ঘরে, আল্লাহকে যে পাইতে চায় ইত্যাদি।
কবি নজরুল একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করলেও বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি সাহিত্য, কবিতা, নাটক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। তার কবিতায় বিদ্রোহ, বিরোহ, ভালোবাসা এবং যুক্তি প্রাধান্য পায়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেসব গানে সুর করেছেন তাকে নজরুলগীতি বলা হয় এবং তিনি প্রায় ৫৬০০ বেশি সংখ্যক গান রচনা করেছেন।
প্রকৃতি, প্রেম, ভালোবাসা, পূজা, গজল, ভক্তিরস, রাগ, বিদেশি সুর, সম্প্রীতি, হাসি দেশাত্মবোধ সকল বিষয়েই সঙ্গীত রচনা করে মুগ্ধ করেছেন আপামর বাঙ্গালীকে। “অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে”, “নয়ন ভরা জল গো তোমার”, “জাতের নামে বজ্জাতি সব”,“বাগিচায় বুলবুলি তুই” , “অরুনকান্তি কে গো যোগী”, “শুকনো পাতার নূপুর পায়ে” ইত্যাদি গানগুলো আজও সবার হ্রিদয়ে অমর হয়ে থাকবে।
এর আগে ১৯১৫ সালে কবি কাজী নজরুল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখানেই তিনি দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। কবি সেখানেই সংস্কৃত, বাংলা, ফারসি সাহিত্য, আরবি, হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত অধ্যয়ন করেছেন। ১৯২৮ সালে তিনি ‘মাস্টার ভয়েস গ্রামোফোন সংস্থা’ এর সুরকার, গীতিকার এবং সঙ্গীত পরিচালক হয়েছিলেন। ‘সিরাজ-উদ-দৌলা’ নামে একটি বায়োপিক নাটকের জন্য গান রচনা এবং পরিচালনা করা ছিলো ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর অন্যতম বৃহত্তম কাজ।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনুরাগ ছিল সর্বজনবিদিত। উচ্চাঙ্গ এবং ক্লাসিকাল সঙ্গীত যে মানুষের হৃদয়ে এক অভিনব রস সৃষ্টি করতে পারে তা আমরা কাজী নজরুল ইসলামের গানগুলোতে দেখতে পাই। কীর্তন, বাউল, ঝুমুর এবং গ্রামের লোক শিল্পীদের কাছ থেকে তিনি অনায়াসে সুর তুলে নিতেন। তিনি এসব সুরের সন্ধান পেয়েছিলেন উস্তাদ কাদের বক্স, উস্তাদ দবির খান, উস্তাদ জমিরুদ্দিন খানের সান্নিধ্যে এসে।
তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনেক তাল সৃষ্টি করেছিলেন। মঞ্জুভাষিনী, নবনন্দন, মন্দাকিনি, মণিমালা, প্রিয়া, স্বাগতা ইত্যাদি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। বহুগুনে গুণান্বিত এই কবিকে ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ‘একুশ পদক’ এবং “জাতীয় কবি” উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করলেও তিনি আজও কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে আছেন তার এই অসামান্য শিল্পকর্মের মাধ্যমে।
তো এই ছিল আজকের নিবন্ধে; আশা করি ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আপনি যদি এমন আরও বাংলাসাহিত্য বিষয়ে নিবন্ধ পড়তে চান, তবে আরও পড়তে পারেন জহির রায়হান-উপন্যাস নাকি চলচ্চিত্র।
Leave a Reply