বাংলা চলচ্চিত্রে বাংলা গান আসলেই বাংলা চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাধারণত প্রতিটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে ৪ টি বা ৫ টি গান থাকে যা চলচ্চিত্রের আবেগকে তরান্বিত করে। গান মানুষের হৃদয়ের আবেগকে একটি নির্দিষ্ট ছন্দের মাধ্যমে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। আর, বিভিন্ন মুহূর্ত কে আরও প্রানবন্ত করতে এইসব গানের ভুমিকা অপরিসীম। এই নিবন্ধটিতে চেষ্টা করবো, বাংলা চলচ্চিত্রে বাংলা গানের ভুমিকা এবং এর অবস্থান যতটা সম্ভব স্পষ্ট করে তুলে ধরার।
এই ক্ষেত্রে আমরা বাংলা চলচ্চিত্রে বাংলা গানের গুরুত্ব; বাংলা চলচ্চিত্রে বাংলা গানের অবদান, এবং যেসব শিল্পিরা বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অবদান রেখেছেন; তা নিয়ে আলোচনা করবো।
বাংলা চলচ্চিত্রে বাংলা গানের গুরুত্ব
বাংলা চলচ্চিত্রের গানগুলো বাংলা চলচ্চিত্রকে সবার কাছে পৌঁছ দেয়। একটি চলচ্চিত্রের গান জনপ্রিয় হলে সেই চলচ্চিত্রের ব্যপারে সবার আগ্রহ জন্মে। বর্তমানে সিনেমার প্রচার করার জন্য সর্বপ্রথম গান এবং ট্রেইলার প্রকাশ করা হয়। যদি গান এবং ট্রেইলার মানুষের পছন্দ হয় তাহলে ঐ সিনেমার ব্যপারে তাদের মনে ইতিবাচক ধারনা হয়।
কোনো একটি সিনেমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করলে দর্শক সেই সিনেমা দেখতে পেক্ষাগৃহে যেতে ইচ্ছুক হয় । একটি সিনেমায় বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য গান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। বাংলা চলচ্চিত্র আর বাংলা গান একই সুত্রে গাঁথা। বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে বাংলা গান। যারা বাংলা গানের সাথে জড়িত, তারা কোনো না কোনোভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের সাথেও জড়িত।
একটি চলচ্চিত্র অনেক কিছুর সমন্বয়ে হয়ে থাকে। কোনো একটি অংশকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। চলচ্চিত্রে গান করা একজন শিল্পীর জীবনে অনেক বড় অর্জন। কিন্তু, এটাও সত্য যে একজন শিল্পী চলচ্চিত্রে গান না গাইলেও তার অনেক বড় সমস্যা হবে না। বরং, ভালো শিল্পীরা চলচ্চিত্রে গান না গাইলে উক্ত চলচ্চিত্র সম্পর্কে সবার নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে।
বাংলা চলচ্চিত্রে বাংলা গানের অবদান
৭০-এর দশকের অনেক চলচ্চিত্রের বাংলা গান আজও শোনা হয়। প্রায় ৫০ বছর আগের চলচ্চিত্র সম্পর্কে সাধারণত আমাদের খুব বেশি জানার কথা না; কিন্তু, চলচ্চিত্রের পুরনো জনপ্রিয় গানগুলোর জন্য সেই চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। ৭০-এর দশকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক চলচ্চিত্র বানানো হয়েছিলো।
সেইসব চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক গান ছিল এবং সেসব গান মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জহির রায়হানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক চলচ্চিত্র ছিল। সেসব চলচ্চিত্রের গানগুলো শুধু মুক্তিযুদ্ধেই অবদান রাখেনি আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রকেও সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়াও ৯০-দশকের বাংলা চলচ্চিত্রগুলো জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড়ো অবদান রেখেছে বাংলা গান।
বাংলা চলচ্চিত্রে যেসব সঙ্গীত শিল্পীরা অবদান রেখেছে
বাংলা চলচ্চিত্রে অনেক সঙ্গীত শিল্পীরা অবদান রেখেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে অবদান রাখা সঙ্গীত শিল্পীরা হলেনঃ সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, এন্ড্রু কিশোর, খালিদ, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, খালিদ হাসান মিলু, আসিফ আকবর, বেবি নাজনিন , কনা, হাবিব ওয়াহিদ, হৃদয় খান, ন্যান্সি, ইমরান মাহমুদুল সহ আরও অনেকেই।
বাংলা চলচ্চিত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক গান গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর । বাংলা চলচ্চিত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার বিখ্যাত চলচ্চিত্রের গানগুলো হলঃ জীবনের গল্প, ভেঙ্গেছে পিঞ্জর, তুমি চাঁদের জোছনা নও, ডাক দিয়াছেন, তুমি এসেছিলে পরশু, আমি পাথরে ফুল ফোটাবো, আমার সারা দেহ, ইত্যাদি।
সাবিনা ইয়াসমিনের অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গান রয়েছে। সেগুলো হলঃ শত জনমের সপ্ন, এ সুখের নেই কোনো সীমানা, সময় হয়েছে ফিরে যাওয়ার, ওরে ও পরদেশি, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, সে যে কেন এলনা, সবাইতো ভালবাসতে চায়, এই মন তোমাকে দিলাম, ইত্যাদি।
বাংলাদেশের অন্যতম কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী রুনা লায়লার অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গান রয়েছে। সেগুলো হলঃ এসোনা ভাব করি, এই বৃষ্টি ভেজা রাতে, চাঁদের সাথে আমি দেবোনা, আমি একদিন তোমায় না দেখিলে, তুমি আমার কত চেনা, যদি বউ সাজোগো, ইত্যাদি।
জেমসের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গানগুলো হলঃ তোর প্রেমেতে, বিধাতা, এতো কষ্ট কষ্ট লাগে, আসবার কালে আসলাম একা, ইত্যাদি। আইয়ুব বাচ্চুর জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গানগুলো হলঃ আম্মাজান, এই জগত সংসারে, সাগরিকা, প্রেমের পৃথিবী, দিনগুলো যায় চলে যায় ইত্যাদি।
আসিফ আকবরকে বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অনেক অবদান রেখেছেন। তার জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গানগুলো হলঃ কখনো কি চেয়েছিলে, তোর হাসি যেন, ও প্রিয়া, সবুজের বুকে লাল, প্রেমের মরন ইত্যাদি।
বেবি নাজনিনের জনপ্রিয় গানগুলো হলঃ এলোমেলো বাতাসে, তুমি কই তুমি কই, আমার জীবন নামের ফুল, জল পরে পাতা নরে ইত্যাদি।
বর্তমান প্রজন্মের নারী সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে কনা এবং ন্যান্সি চলচ্চিত্রে ভালো গান গাচ্ছে। কনার জনপ্রিয় গানগুলো হলঃ ছুয়ে দিলে মন, হায় আল্লাহ, মন বলেছে, বন্ধু বিনে, দিল দিল, তুই কি আমার হবি রে, ইত্যাদি। ন্যান্সির জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গানগুলো হলঃ অনেক সাধনার পরে, ভেজা ভেজা, ভালোবাসাই হল না, তোমারে দেখিলো পরানো ভরিয়া ইত্যাদি।
নতুন প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে ইমরান, হাবিব এবং হৃদয় খান এগিয়ে আছে। হাবিবের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গানগুলো হলঃ তোমাকে ছেড়ে আমি, আমি তোমার মনের ভেতর, ভালোবাসা দাও ভালোবাসা নাও, পৃথিবীর যত সুখ, ইত্যাদি। হৃদয় খানের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গানগুলো হলঃ এক ঝলকে, ভালো লাগে না, লক্ষ্মীসোনা, অবুঝ ভালোবাসা, মনে রেখ, ইত্যাদি।
বর্তমানে চলচ্চিত্রের গানের চাহিদার শীর্ষ তালিকায় রয়েছেন ইমরান মাহমুদুল। ইমরান মাহমুদুলের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের গানগুলো হলঃ রাতভোর, ওহে শ্যাম, মন বলেছে, তুই কি আমার হবি রে, আলতো ছোঁয়াতে, তুমি আমার জীবন ইত্যাদি।
বাংলা চলচ্চিত্রে বর্তমানে বাংলা গানের অবস্থা
বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে। বর্তমানে বেশির ভাগ চলচ্চিত্রের বাজেট কমে যাওয়ায় চলচ্চিত্রের মান কমে যাচ্ছে। মিউজিক কোম্পানির তুলনায় অনেক কম পারিশ্রমিক দেয়ার কারণে অনেক গুণী সঙ্গীত শিল্পীরা এখন আর চলচ্চিত্রে গান গাইতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এবং, পারিশ্রমিক কম হাওয়ায় নতুন ধরনের গানও তৈরি করছে না শিল্পিরা।
এবং তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা হচ্ছ এইসব সিনেমায় অপেশাগত নিম্নমানের গান ও গানের মিউজিক ডিরেক্টর। তাই, আমাদের চলচ্চিত্রের উন্নতির জন্য আমাদের সর্বপ্রথম চলচ্চিত্রের মান উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এবং, শিল্পীদের তাদের যথাযথ পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
আশা করি নিবন্ধটি ভালো লেগেছে, চাইলে আরও পড়তে পারেন; বাউল গানের ইতিকথা
Leave a Reply