ক্রাইম থ্রিলারে ফেলুদাই সেরা! হ্যাঁ, এটা আজকের মূল বিষয়। যদি আপনি একজন বাংলা ক্রাইম থ্রিলার রিডার হন, আর আপনি ফেলুদা সিরিজ পড়েননি, এইটা হতেই পারে না। আর, আপনি পড়ে থাকলে অবশ্যই বলবেন বাংলা ক্রাইম থ্রিলারে ফেলুদাই সেরা। “ফেলুদা” হল ভারতীয় বাঙালি লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্প নির্দেশক সত্যজিৎ রায় এর সৃষ্ট একটি বাংলা কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র।
আর, সেই গোয়েন্দা চরিত্রকে ঘিরেই যত গল্প-কাহিনীর সমাবেশ হয়েছে, তা বাংলা সাহিত্যের সেরা ক্রাইম থ্রিলার হয়েছে পরবর্তীতে। আজকের এই নিবন্ধটি হল ” ক্রাইম থ্রিলারে ফেলুদাই সেরা ” শিরনামে ফেলুদা বই রিভিউ।
ফেলুদা পরিচিতিঃ ফেলুদা বই রিভিউ
প্রথমে শুরু করি “ফেলুদা” চরিত্র পরিচিতি থেকে। ফেলুদা চরিত্রটি অনুপ্রানিত হয়েছে স্কটিশ লেখক ও চিকিৎসক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এর ইংরেজি গোয়েন্দা কাহিনী ” শার্লক হোমস ” এর থেকে। তাই, ফেলুদা কাহিনীতে ফেলুদার ভাইয়ের চরিত্রে হোমসের আর সহকারী তোপসের সাথে হোমসের সহকারী ওয়াটসনের মিল পাওয়া যায়।
আর, সত্যজিৎ তার লেখা বেশির ভাগ বইয়ের মতই নিজেই ফেলুদার সব অলঙ্করন আর প্রচ্ছদ করেছেন। ফেলুদা গল্পটি প্রথমভাগ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ” সন্দেশ ” পত্রিকায়। এবং, পরবর্তী আরও দুইত সংখার মাধ্যমে শেষ হয় সেটি। এরপর ১৯৬৫- ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত মোট ৩৫টি সম্পূর্ণ ও ৪টি অসম্পূর্ণ গল্প- উপন্যাস প্রকাশ করেন ফেলুদা চরিত্র নিয়ে।
অধিকাংশ ফেলুদা কাহিনী প্রথম “দেশ” পত্রিকায় পূজাসংখ্যানে প্রকাশিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে বলা যায়, অল্প কিছুই প্রকাশিত হয়েছিল ” সন্দেশ ” পত্রিকায়। সব গুলো গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছিলো ” আনন্দ পাবলিশার্স ” থেকে। আর, ফেলুদার সব গুলো গল্প- উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
ফেলুদার ব্যক্তিত্ব ও কর্মজীবন
প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদাকে লেখক সত্যজিৎ রায় চিত্রিত করেছেন ২৭ বছর বয়সী একজন যুবক হিসেবে এবং তিনি উচ্চতায় ৬’২”। একজন দক্ষ মার্শাল আর্টিস্ট। আর যেকোনো বিষয় খুব সহজে বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখতেই ভালোবাসেন; তবু তিনি তার এই ক্ষমতাকে মগজাস্ত্র বলে মজা পান।
তার, তার কাছে যদিও সব সময় বাড়তি সতর্কতার জন্য সবসময় একটি নিজস্ব পয়েন্ট থ্রি টু কোল্ট রিভলভার থাকতো; তবে তাকে গুলি চালাতে খুব কমই দেখা গেছে। তাকে দেখা গেছে পাড়াগাঁয়ের ছোট-খাটো বিষয়েও গোয়েন্দাগিরি করতে। আর তার স্বভাব অনুযায়ী কোন বিষয়ে তদন্ত করার আগে তিনি সেই রহস্যের বিস্তার থাকুক; তা বিস্তারিত পড়াশোনা করে তিনি যেতেন তদন্তের পূর্বে।
তার গোয়েন্দা পেশায় সহকারী হিসেবে আছে দুইজন চরিত্র। একজন হলো ফেলুদার প্রধান সহকারী আরেকজন সহকারী ও তার বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলি বা ছদ্মনামে ” জটায়ু “। প্রধান সহকারী হলেন ফেলুদার খুড়তুতো ভাই তপেশরঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে।
ফেলুদার ব্যক্তিগত জীবন
প্রদোষ চন্দ্র মিত্র বা ফেলুদা; তার বাবা জয়কৃষ্ণ মিত্র ছিল পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে গণিত ও সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন। তার মা- বাবা মারা যায় যখন তার মাত্র ৯ বছর। তাই বলা যায়, ফেলুদা আসলে একজন অনাথ। আর তার পর থেকেই সে থাকতো তার বাবার ছোট ভাই এর বাড়িতে, আর তপেশরঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে তার সেই কাকারই ছেলে।
ফেলুদার মতে পেশায় তিনি গোয়েন্দা হলেও, এটা তার নেশাও বটে; এবং তিনি গয়েন্দাগিরি সুরুর আগে একটা বেসরকারি অফিসে চাকরী করতেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে গোয়েন্দা পেশায় নিযুক্ত হন; নিজস্ব নেশা সামলাতে। আর তার কাকাতো ভাই আর প্রধান সহকারী তোপসের নেশা বলতে একটাই; সিগারেট। আর সিগারেট এর প্রিয় ব্র্যান্ড “চারমিনার”।
ফেলুদা প্রত্যেক সকালে নিয়মিত শরীরচর্চা ও যোগব্যায়ামে অভ্যস্ত; আর তিনি প্রচুর বই পরতেন এবং সমকালীন ও সাম্প্রতিক সব বিষয়ে তিনি সজাগ থাকতেন। যার কারণে তিনি তার গোয়েন্দা পেশাতেও এগিয়ে থাকতেন।
ফেলুদা সিরিজে মোট কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছিল?
ক্রাইম থ্রিলারে ফেলুদাই সেরা; এটা বুঝতে চাইলে ফেলুদা সিরিজের সবগুলো বই পড়তেই হবে। এইখানে আমি ফেলুদা সিরিজে প্রকাশিত সবগুলো বইয়ের তালিকা করবো যেন আপনারা ফেলুদা সিরিজের সবগুলো বই সম্পর্কে অবগত থাকতে পারেন। আগেই বলে রাখি, সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ মিলে মোট ৩৮ টি বই প্রকাশিত হয়েছিলো ফেলুদা সিরিজে।
ফেলুদা গল্প/উপন্যাস | প্রকাশকাল ও গ্রন্থভুক্তি | প্রচ্ছদ |
ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি (গল্প) | সন্দেশ পত্রিকা, ডিসেম্বর ১৯৬৫- ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬
এক ডজন গপ্পো- ১৯৭০, পাহাড়ে ফেলুদা- ১৯৯৬ |
|
বাদশাহী আংটি (উপন্যাস) | সন্দেশ পত্রিকা,১৯৬৬ মে- ১৯৬৭মে
বাদশাহী আংটি -১৯৬৯ |
|
কৈলাস চৌধুরীর পাথর (গল্প) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৬৭
এক ডজন গপ্পো, ১৯৭০ |
|
শেয়াল-দেবতা রহস্য (গল্প) | সন্দেশ গ্রীষ্ম সংখ্যা,১৯৭০ মে-জুন,
আরো এক ডজন, ১৯৭৬ |
|
গ্যাংটকে গন্ডগোল (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৭০
গ্যাংটকে গণ্ডগোল, ১৯৭১ |
|
সোনার কেল্লা (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৭১
সোনার কেল্লা, ১৯৭২ |
|
বাক্স-রহস্য (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৭২
বাক্স-রহস্য, ১৯৭৩ |
|
কৈলাসে কেলেঙ্কারি (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৭৩
কৈলাসে কেলেঙ্কারি, ১৯৭৪ |
|
সমাদ্দারের চাবি (গল্প) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৭৩
আরো এক ডজন, ১৯৭৬ |
রয়েল বেঙ্গল রহস্য (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৭৪
রয়েল বেঙ্গল রহস্য, ১৯৭৫ |
|
ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা (গল্প) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৭৫
আরো এক ডজন, ১৯৭৬ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
জয় বাবা ফেলুনাথ (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৭৫
জয় বাবা ফেলুনাথ, ১৯৭৬ |
|
বোম্বাইয়ের বোম্বেটে (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৭৬
ফেলুদা এণ্ড কোং, ১৯৭৭ |
|
গোঁসাইপুর সরগরম (উপন্যাস) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৭৬
ফেলুদা এণ্ড কোং, ১৯৭৭ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
গোরস্থানে সাবধান! (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৭৭
গোরস্থানে সাবধান!, ১৯৭৯ |
|
ছিন্নমস্তার অভিশাপ (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৭৮
ছিন্নমস্তার অভিশাপ, ১৯৮১ |
|
হত্যাপুরী (উপন্যাস) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৭৯
হত্যাপুরী, ১৯৮১ |
|
গোলকধাম রহস্য (গল্প) | সন্দেশ, মে-অগস্ট, ১৯৮০
আরো বারো, ১৯৮১ |
|
যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৮০
যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে, ১৯৮১ |
নেপোলিয়নের চিঠি (গল্প) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৮১
ফেলুদা ওয়ান ফেলুদা টু, ১৯৮৫ |
|
টিনটোরেটোর যীশু (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৮২
টিনটোরেটোর যীশু, ১৯৮৫ |
|
অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য (গল্প) | আনন্দমেলা, ৪ মে-১৫ জুন, ১৯৮৩
এবারো বারো, ১৯৮৪ |
|
জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা (গল্প) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৮৩
এবারো বারো, ১৯৮৪ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
এবার কাণ্ড কেদারনাথে (গল্প) | শারদীয় দেশ, ১৯৮৪
ফেলুদা ওয়ান ফেলুদা টু, ১৯৮৫ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
বোসপুকুরে খুনখারাপি (গল্প) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৮৫
একের পিঠে দুই, ১৯৮৮ |
|
দার্জিলিং জমজমাট (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৮৬
দার্জিলিং জমজমাট, ১৯৮৮ পাহাড়ে ফেলুদা, ১৯৯৬ |
|
অপ্সরা থিয়েটারের মামলা (গল্প) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৮৭
ডবল ফেলুদা, ১৯৮৯ |
|
ভূস্বর্গ ভয়ংকর (গল্প) | শারদীয় দেশ, ১৯৮৭
ডবল ফেলুদা, ১৯৮৯ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
শকুন্তলার কণ্ঠহার (গল্প) | শারদীয় দেশ, ১৯৮৮
আরো সত্যজিৎ, ১৯৯৩ |
লন্ডনে ফেলুদা (গল্প) | শারদীয় দেশ, ১৯৮৯
ফেলুদা প্লাস ফেলুদা, ১৯৯২ |
|
ডাঃ মুনসীর ডায়রি (গল্প) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৯০
বাঃ! বারো, ১৯৯৪ |
|
নয়ন রহস্য (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৯০
নয়ন রহস্য, ১৯৯১ |
|
রবার্টসনের রুবি (উপন্যাস) | শারদীয় দেশ, ১৯৯২
রবার্টসনের রুবি, ১৯৯১ |
|
গোলাপী মুক্তা রহস্য (গল্প) | ফেলুদা প্লাস ফেলুদা, ১৯৯১ ফেলুদার সপ্তকাণ্ড, ১৯৯৮ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
ইন্দ্রজাল রহস্য (গল্প) | সন্দেশ, ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫-৯৬
কলকাতায় ফেলুদা, ১৯৯৮ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
বাক্স রহস্য (প্রথম খসড়া) (অসম্পূর্ণ | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৯৫
ফেলুদা একাদশ, ২০০০ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
তোতা রহস্য (প্রথম ও দ্বিতীয় খসড়া) (অসম্পূর্ণ) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৯৬
ফেলুদা একাদশ, ২০০০ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
আদিত্য বর্ধনের আবিষ্কার (অসম্পূর্ণ) | শারদীয় সন্দেশ, ১৯৯৭
ফেলুদা একাদশ, ২০০০ |
উপরে লক্ষ্য করুন! |
ক্রাইম থ্রিলারে ফেলুদাই সেরা
ক্রাইম থ্রিলারে ফেলুদাই সেরা। বিষয়টা বোঝা যাবে পুরো সিরিজ টি পোড়ার পর। যদিও বাংলা সাহিত্যে আরেকটি প্রবল গোয়েন্দা চরিত্র আছে; তা হলো “মাসুদ রানা”। যদিও সিরিজটিতে মোট ৪৬৮ টি বই প্রকাশিত হয়েছে যদি মূল গল্পের বই ৩২১ টি। কিন্তু, চরিত্রায়ন এর পর সেই চরিত্রের বিস্তৃতি এতটা সম্প্রসারিত হয়েছে যে তাকে কিছু মুহূর্তের জন্য মানব নয় বরং মৃত্যুহীন অতিমানব অথবা অশরীরী মনে হয়।
অপরদিকে, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার চরিত্রায়ন অত্যন্ত সাবলীল এবং যুক্তিযুক্ত; আর সেখানে যেই সহকারী চরিত্র গুলো বানানো হয়েছে তাঁদের চরিত্র ও অত্যন্ত সাবলীল ভাবে ফুটে উঠেছে। সেখানে সব চরিত্রের নিজস্ব চিন্তা ও চরিত্র আছে। আর, যেই গল্প গুলো সাজানো হয়েছে; তাতে খুব সূক্ষ্ম রহস্যের দুয়ার খোলা রাখা হয়েছে। যার ভেতরের রহস্যের বিস্তৃতি অপরিসীম। তার মাঝেই চলছে একটি নির্দিষ্ট ঘটনার রহস্যের উদ্ঘাটন।
আর, সেই গল্পগুলো বিভিন্ন জায়গায় যখন ঘুরে বেড়ায় একটা রহস্যের গন্ধ মেখে; তখন বিষয়গুলো আরও বেশি বাস্তবতা পায়; হয়ে ওঠে আমাদের আশে পাশে ঘটে যাওয়া কোন এক বাস্তব ঘটনার কল্পিত রহস্য। আর যার কারণে; “ফেলুদা” গল্পের বিষয়গুলো বেশ হৃদয় ছোঁওয়া হয়ে যায়। তাই, আমার ব্যক্তিগত মতে ” বাংলা ক্রাইম থ্রিলারে ফেলুদাই সেরা”। এর বেশি কিছু বলার নেই; কারণ যারা এটি পড়ছেন; আমি তাঁদের বলবো বই গুলো পড়েন; আপনাদের নিজস্ব অনুভূতিতে।
তো এই ছিল নিবন্ধটির মূল প্রশঙ্গ। আশা করি খুব স্বল্প সময়েই পড়তে পেরেছেন। যদি এমন আরও নিবন্ধ পড়তে চান; তবে আরও পড়তে পারেন। যেমন; হুমায়ূন আজাদ- এর ‘নারী’ কেন নিষিদ্ধ?
Leave a Reply