March 26, 2024
ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য!

ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য!

ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য! ধারণা করা হয়; সময়ের মতো কল্পিত মাত্রাকেও গ্রাস করতে সক্ষম ব্লাকহোল। আর, সেখানে আমদের এই অল্পবয়সী যৌবনঢলো বাংলা সাহিত্য। অনুমানে বয়স ১৪০০ বছর, প্রমাণে বয়স ১০০০ বছর আর নবজাগরণ- নবায়ন আর আধুনিকায়নে ২৫০ বছর। তারপর ”দাদা বলচেন” আর ”ভাই বলছেন”; ভাগ হয়ে গেল গরুমারা আর ছাগল্ধরা। এই দুইয়ের মাঝখানের দেয়ালে আরও দুর্বল হয়ে পড়লো যৌবনঢলো বাংলা সাহিত্য। এখন, বাংলা সাহিত্যের অবস্থা অনেক খানি, বিধি তুমি বলে দাও আমি কার; পশ্চিমবঙ্গ নাকি পূর্ব-বাংলার!?

যাহোক, মুল জ্ঞাতব্যে আসি; ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য। ক্রমাগত গ্রাস হচ্ছে আমাদের মেধা,মনন, অনুসন্ধিচ্ছা   এবং সৃষ্টিশীলতা। হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা সাহিত্য থেকে বাংলার মূল বা শেকড়ের ধারা। এই নিবন্ধটিতে চেষ্টা করবো, বাংলা সাহিত্যের এইসব অধঃপতন নিয়ে কথা বলতে এবং চেষ্টা করবো সবগুলো ঘুণে খাওয়া জায়গাকে চিহ্নিত করতে।

অসাড় মস্তিষ্কের নেপথ্যে ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য

বর্তমান সময়ে, ভাল্লাগেনা- শব্দের নেপথ্যে অসাড় হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক। আর, তারপর কোন দিক, তথ্য, উপাত্ত কিংবা কোন বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন না করেই লেখা হচ্ছে একের পর এক বই; যাতে ভর্তি হচ্ছে শুধু বইয়ের তাক, কিন্তু, সমৃদ্ধ হচ্ছে না জ্ঞান। ফলে দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে মস্তিষ্কের অসাড়তা।

বেশির ভাগ যুবারা বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তুলছে শুধু মাত্র বুলি এঁড়ে বেড়ানোর জন্য, কিংবা শুধু পরীক্ষাতে পাস করার জন্য। যারা বই লেখছেন এবং বই ছাপাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগেরই ব্যস্ত সময় কাটে এইসব গাইড বা সহায়ক বই, সাপ্লিমেন্ট কিংবা পরীক্ষায় সহজে পাস করার জন্য প্রস্তুতকৃত বই ছাপিয়ে- প্রকাশ করে।  বেশির ভাগ ছাপা খানায় এই সবেরই কাজ চলে। তারপর, বড় বড় সাহিত্য প্রকাশনি যারা আছেন, তাদের বেশির ভাগই আবার ছাপাচ্ছেন সময় উপযোগী বই; যেগুলোর ভেতরকার সাহিত্য এই সময়ের মতই ভেসে যাওয়া।

তাতে বর্তমান শুধু তথা কথিত প্রেম, ভবঘুড়ে জীবন বৃত্তান্ত যাতে শুধু ভবঘুরে স্বভাবটাই আছে, নেই শিক্ষামূলক কিংবা চিন্তার সাগরে ডুবে যাওয়ার মতো কোন দর্শন। মাঝে মধ্যে, এমন বিমূর্ত কিছু সাহিত্য প্রকাশিত হচ্ছে যাতে সব কিছুই বিমূর্ত, স্পষ্ট নয় কিছুই। বোঝা যায়না সেই সাহিত্যের ভাব-ধারা-দর্শন। ফলে শুধু সাহিত্যটি পঠিতই থেকে যায়, পাঠকের তাতে কোন উপকার হয় না। আর, আগে থেকেই চিন্তাশক্তির লোপ পাওয়ায়, নতুন করে খোঁজে না সেই বিমূর্তের কোন কল্পিত মূর্তি। তাই আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আবার প্রয়োজন স্পষ্ট সাহিত্য।

যাতে, সব কিছুই থাকবে স্পষ্ট। সময়ের দাবি তুলবে, সময়ের কথা বলবে, ভবিষ্যতের কথা বলবে, ভবিষ্যতের দাবি তুলবে, আত্নার কথা বলবে, সত্তার কথা বলবে, ভালোবাসার গভিরতা নিয়ে কথা বলবে, প্রীতি- সৌহার্দের কথা বলবে, সুন্দর- কুৎসিত সব নিয়ে কথা বলবে। আর স্পষ্ট কথা বলবে। তা না হলে অস্পষ্ট অন্ধকারেই গ্রাস হবে ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য।

বর্তমান বাংলা সাহিত্যের ঘুণে খাওয়া জায়গা

বর্তমান বাংলা সাহিত্যের অর্ধেকের বেশি অংশ ঘুণে খাওয়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। শোচনীয় এই অবস্থায় যদি দ্রুত আমরা এই ঘুণে খাওয়া অংশকে বাদ না দেই তবে খুব দ্রুতই ভেঙ্গে পরবে বাংলা সাহিত্যের লেখনীর চারপায়ের টেবিল। প্রথমত আমি যেই সব ঘুণে খাওয়া জায়গাকে চিহ্নিত করতে যাচ্ছি তা নিয়ে এই নিবন্ধের নিম্ন অংশে অল্পবিস্তর আলোচনা করার চেষ্টা করবো। নিচে আমি ঘুণে খাওয়া দিক গুলোকে সংখ্যার ক্রম অনুসারে সাজাবো।

আর আগেই বলে দেই, সংখ্যার ক্রম; ঘুণে খাওয়া জায়গা গুলোর গুরুতরতা কিংবা গভীরতা নির্দেশ করে না। কারণ, আমাদের অলস স্বভাবের দায়ে আমরা প্রত্যেক বার সমস্যা সমাধানের আগেই সেগুলোর গভীরতা এবং গুরুতরতা নির্ধারণ করি, ফলে শুধু একটা বড় সমস্যা সমাধান নিয়ে আমারা পড়ে থাকি, আর অন্য ছোট সমস্যা দিন দিন ক্রমাগত বড়ই হতে থাকে। আর ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য।

  • শুধু মাত্র জনপ্রিয় লেখকদেরই বিপুল পরিমান বই ছাপানো
  • নতুনদের সুযোগ কম দেয়া, কিংবা না দেয়া
  • নতুন ধারার সাহিত্যে অনিচ্ছা পোষণ এবং পৃষ্ঠপোষকতা না করা
  • বাংলা ভাষার সাহিত্যে এপাড়- ওপাড় বাংলা ভাগ করা

শুধু মাত্র জনপ্রিয় লেখকদেরই বিপুল পরিমান বই ছাপানো

প্রত্যেক বছর অমর একুশে বই মেলায়, কিংবা অন্যান্য সময় একটা বিষয় লক্ষ করা যায়, তা হল নুতুন লেখকদের বই কম ছাপানো এবং যারা আগে থেকেই জনপ্রিয় তাদের বই বিপুল পরিমান ছাপানো হয়। এক্ষেত্রে, আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়; তা হল পাঠকদের নতুন সাহিত্য চর্চায় বেশ অনিহা জন্মেছে এই গত দুই দশক ধরে।

যদিও দেখা যায় প্রত্যেক বছর বই মেলায় মানুষের ভীড় যে হারে বাড়ছে, ঠিক সেই হারে পাঠকদের সংখ্যা বাড়ছে না। ফলে, আশাহত হচ্ছেন বই বিক্রেতারা। আর, যারা নতুন পাঠক কিংবা পাঠক নন; কিন্তু, পাঠক বন্ধুদের সাথে যারা ঘুরতে আসেন, তাদের বেশির ভাগের পাঠক বন্ধুই তাদের কাছে তুলে দেন তাদের জীবনে পড়া শ্রেষ্ঠ বই! যাতে করে দেখা যায়; শুধু মাথা ভাড় হয় নতুন পাঠকের।

আর, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যখন ১০০০ বার তখন শুধুমাত্র জনপ্রিয় শ্রেষ্ঠ লেখকদের বই-ই বিক্রি হয়। আর, যেহেতু নতুন লেখদের বই তেমন বিক্রি হয়না। তাই, শুধু জনপ্রিয় লেখকদের বই বিপুল পরিমানে ছাপানো হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তোলনের ক্ষেত্রে; আমাদের উভয়ের উচিত সমতা ধরে রাখা। এবং, প্রকাশকদের উচিত পাঠকদের নতুন লেখদের সাহিত্য পাঠে উদ্বুদ্ধ করা এবং বিশুদ্ধ সাহিত্য প্রকাশ করা। পাঠকদের উচিত; যেসব  প্রকাশনি থেকে তারা বই কেনেন তাদের ওপর বিশ্বাস রাখা।

এবং শুধুমাত্র লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মধ্যে পারস্পারিক সুসম্পর্ক না তৈরি হলে এই সমস্যা সমাধান হবে না। আর করমাগত এগিয়ে যাবে ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য।

নতুনদের সুযোগ কম দেয়া, কিংবা না দেয়া

বর্তমান বাংলা সাহিত্যের অধঃপতন নিয়ে কথা বলতে গেলে দেখা যায়; খুব বেশি নতুন লেখক বা কবি তাদের মেধা বা সাহিত্য প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়; নতুন লেখকরা তাদের সাধারণ পরিচয়ের কারণে প্রকাশকদের কাছে যাওয়া বা যোগাযোগের সুযোগই পান না।

আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী; এখানে প্রত্যেক ক্ষেত্রে একটি পরিচয় এর প্রয়োজন হয়। যদি খাঁটি বাংলায় বলা হয়; তবে বলা যায় ”দালাল” ধরতে হয়। এই কথা অস্বীকারকারী যে স্পষ্ট মিথ্যা বলছেন; তা আমরা সবাই জানি। আর বড় দুঃখের সাথে বলতে হয় এই কারণে আমাদের ” Low Profile” বা সাধারণ পরিচয়ের লেখকরা তাদের কথা প্রকাশকদের পর্যন্ত পুছাতেই পারেন না।

তারপর, আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় এই বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যে; যদি নবীন লেখকদের সুযোগ দেয়ার কথা বলি। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে যেইসব নবীন লেখকরা তাদের লেখা প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন; তাদের বেশির ভাগই এসেছেন বিভিন্ন সামাজিক গন-যোগাযোগ মাধ্যম থেকে। বলা যায় বেশির ভাগই এসেছে ফেসবুক থেকে; এবং তাদের লেখা বা সাহিত্য কতটা সারবজনিন তা না ভেবেই শুধুমাত্র বহুল প্রচলিত আর বিতর্কিত বলেই প্রকাশ হচ্ছে তাদের লেখা বই।

দেখা গেছে, সেখানে অশুদ্ধ চলতি ভাষার ব্যবহার, বানান জটিলতা, অনর্গল বাংলায় লেখা ইংরেজি উচ্চারণ এবং গুরুচণ্ডালী। বেশির ভাগের লেখার বিষয় গতানুগতিক ভাবধারা এবং প্রেরণামূলক লেখনী; যদিও সেইসবে কোন গভীর দর্শন নেই। ফলে, আবার সেই অলস মস্তিষ্কেই বিলীন হচ্ছে আমাদের বাংলা সাহিত্য; আর ক্রমাগত এইসবের কারণেও এগিয়ে যাচ্ছে ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য।

নতুন ধারার সাহিত্যে অনিচ্ছা পোষণ এবং পৃষ্ঠপোষকতা না করা

নতুন ধারার সাহিত্যের ওপর বেশির ভাগ প্রকাশক-পাঠকদেরই অনিচ্ছা দেখা যায়। এক্ষেত্রে বিষয় এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, পাঠকরা বই কিনতে এসে বেশির ভাগ সময় জনপ্রিয় এবং পুষ্ট লেখকদেরই বই খোঁজেন। ফলে পাঠকদের এই চাহিদা পূরণে প্রকাশকরা জনপ্রিয় সব বই-ই বেশি ছাপান। এবং আমাদের দেশের বা বাংলা সাহিত্যের বেশির ভাগ পাঠকই ধরে নিয়েছেন যে বাংলা আধুনিক সাহিত্যের শেষ ধারায় আমরা এসে গেছি এখানে বোধহয় আমরা আর নতুন কিছু পাব না, তাই আশা করাই বৃথা!

আমি বলবো, পাঠকদের এই বোধ হওয়াটাও অলসতার চেয়ে কম কিছু না। আমার বিশ্বাস, যতজন পাঠক আছেন; এবং তারা যে জ্ঞান ধারন করেন, তাতে তারাও ভেবে লিখতে পারেন নতুন কিছু। কিন্তু, এখানে শুধু মাত্র অলসতার কারণে লেখকের ফেলে দেয়া কলমটা মাটিতেই পরে আছে। তাকে তুলে পুনরায় লিখছেন না কেও।

আর, তারপর যখন কোন হাড্ডিসাড়, কিংবা বলতে পারেন যারা অর্থাভাবে নতুন কিছু করতে পারেননা; এমন কেও যখন কলমটি উঠিয়ে লেখা শুরু করে, তাদের আর তখন কোন রকমের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় না। যদিও অনেকেই বলবে; ” অর্থের অভাবে নজরুল তো আটকে থাকেননি! ” সে ক্ষেত্রে আমি বলবো, ” আমি চুপ থাকবেন! এবং যা জানেন না, তা নিয়ে কথা বলবেন না। ” সেই সময়ে শত্রুরাও ছিল শিক্ষিত আর বন্ধুরাও; তাই নজরুলের তেমন বেগ পেতে হয়নি।

কিন্তু, আজকের সময়ে আমাদের শত্রুরা আজও শিক্ষিত হলেও আমাদের বন্ধুরা মূর্খ। তাই, অনেক সময় নিজের মধ্যেই মরে যায় আমাদের সাহিত্য। মরে যায়, আর মরে যাচ্ছে অভাবের তাড়নায় আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রকৃত মেধা।

তাই জার্মান কবি বের্টোল্ট ব্রেখট – এর একটি কবিতার পঙক্তির ভাষায়;

সাবধান! আপনাদের রাগ-ঘৃণাকে আটকান;
কেননা যে জন্মেছে,
সে জন্মানোদের সাহায্য চায়।

 যদি এমনি পৃষ্ঠপোষকতাহীনতা এবং নতুন ধারার সাহিত্যে অনিচ্ছা পোষণ করার প্রবনতা বাড়তেই থাকে, তবে এগিয়ে যাওয়া ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য, চলে যাবে সরাসরি ব্লাকহোলের গর্ভে! 

বাংলা ভাষার সাহিত্যে এপার- ওপার বাংলা ভাগ করা

যদিও এই বিষয়টি বর্তমানে সময়ে তেমন কোন মহামারি নয়; তবু বলে রাখা উচিত; আমরা যদি বাংলা ভাষার সাহিত্যের উন্নতি চাই, তবে বাংলা ভাষার কোন সত্তাকে বাদ দেয়া যাবে না। এবং, যারা বাংলা সাহিত্যের চর্চা করেন বলে দাবি করেন; তাদেরও উচিত পুরো বাংলা সাহিত্যের চর্চা করা। এক্ষেত্রে কোন ধর্ম বা রাষ্ট্র যেন আমাদের এই বিষয়ে কোন ভাগ না করতে পারে।

কিংবা, ” কলকাতার লেখক ” অথবা ” বাংলাদেশের লেখক ” এই দুই-এর কোনটিই যেন একে ওপরের কাছে গালির মতো না শোনায়। আর, আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদের এই মাতৃভাষাকে যেন অন্তত নিজেরা নিজেদের মনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে, লালন করতে পারি এমন কিছু সাহিত্য এইখানে দৃশ্যমান করা।

ফিরে আনা সেই হারিয়ে যাওয়া মূল ধারা, যা বর্তমানে ধর্ষিত হচ্ছে। নতুন ধারা যোগ করা যা এই সাহিত্যকে আরও পরিপূর্ণতা দিবে। তা না হলে আবার সেই ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য! হারিয়ে যাবে হয়তো খুব শীঘ্রয় কালের অন্ধকার গর্ভে আর আমরা হয়ে যাবো শেকড় ছেড়া গাছের মতো, যাদের মৃত্যু খুব শীঘ্রয়।

আশা করি, পুরো নিবন্ধটি পড়েছেন। যদি পড়ে থাকেন, তবে আপনাকে ধন্যবাদ। আর, চাইলে আরও অন্য কিছু পড়তে পারেন; আধুনিক বাংলা গানে প্রেম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *