April 14, 2024
বাংলা সাহিত্যে কল্প-বিজ্ঞান বৃত্তান্ত

বাংলা সাহিত্যে কল্প-বিজ্ঞান বৃত্তান্ত

বাংলা সাহিত্যে কল্প-বিজ্ঞান বেশ ক্ষুদ্র একটি অংশ। ইউরোপীয় সাহিত্যের ধারা থেকে অনুপ্রানিত হয়ে বাংলা সাহিত্যে এই কল্প-বিজ্ঞান সাহিত্যের উৎপত্তি। এই নিবন্ধটিতে চেষ্টা করবো বাংলা সাহিত্যে কল্প-বিজ্ঞান শাখা নিয়ে যতো তথ্য দেয়া সম্ভব; দেয়ার চেষ্টা করবো।

আমরা অনেকেই হয়ত ভাবি, শুধুমাত্র জাফর ইকবাল কিংবা হুমায়ূন আহমেদ-ই দু’জন লেখক যারা বাংলা সাহিত্যে কল্প-বিজ্ঞান নিয়ে কিছু লিখেছেন, তবে আজকে আমারা আলোচনা করবো বাংলা সাহিত্যে কিভাবে কল্প-বিজ্ঞানের সুচনা হল।

বাংলা সাহিত্যে কল্প- বিজ্ঞান- এর সুচনা

বাংলা সাহিত্যে কল্প- বিজ্ঞানের সুচনা হয় আঠারো শতকের শেষের দিকে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে সাহিত্যের শুরুর দিকে কল্প-বিজ্ঞান সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়। এবং, কল্প- বিজ্ঞান সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে বেশির ভাগ সময় কল্পকাহিনী হিসেবেই বেশি পরিচিত।

বাংলা সাহিত্যে কল্প বিজ্ঞান সাহিত্যের সুচনা হয় আচার্য স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু -এর হাত ধরে। তিনি ১৮৮৯ সালে তাঁর প্রথম কল্প- বিজ্ঞানের গল্প লেখেন যার নাম ” নিরুদ্দেশের কাহিনী ”  এবং যা ” অব্যক্ত ” গল্প গ্রন্থে ” পলাতক তুফান ” নামে প্রকাশিত হয়।

এর এক দশক আগে রবীন্দ্রনাথ এর একান্ত নজরাবৃত জগদানন্দ রায় এর বিজ্ঞান কল্প-কাহিনী ” শুক্র ভ্রমণ ” প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালে। তবে তাঁর গ্রন্থটিতে ইউরেনাস এবং শুক্রে দেখা প্রাণীদের বর্ণনায় চার্লস ডারউইন এর বিবর্তনবাদের অনুরূপ তত্ত্ব ব্যাবহার করা হয়েছে। তাই আচার্য স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকেই বলা হয় বাংলা সাহিত্যের কল্প-বিজ্ঞান সাহিত্যের জনক।

তবে কিছু বিশেষজ্ঞ আবার হেমলাল দত্তকে তাঁর ” রহস্য ” নামক কল্প-বিজ্ঞান কাহিনীর জন্য বাংলা কল্প-বিজ্ঞান সাহিত্যের প্রথম ও প্রধান লেখক হিসেবে অভিহিত করেছেন।  ” রহস্য ” গল্পটি  “বিজ্ঞানের দর্পণ” নামক চিত্রিত পত্রিকায় দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে।

বাংলা সাহিত্যে কল্প- বিজ্ঞান- এর বিকাশ

অবিভক্ত বাংলায় প্রথম বাংলা কল্প-বিজ্ঞানের কথাসাহিত্য রচনা শুরু করেন পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালি লেখকরা। এবং প্রথম বাঙালি বিজ্ঞান কথাসাহিত্যের গল্পের জন্য সমাদৃত হয়ে আছেন জগদানন্দ রায়, হেমলাল দত্ত এবং বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। এমনকি সত্যজিৎ রায়ও চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখেছেন।

তাঁর বিখ্যাত চরিত্র প্রফেসর শংকু হিসেবে; তিনি তাঁর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর ধারাবাহিক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। প্রফেসর শংকু হলেন সত্যজিৎ রায়ের কল্পিত চরিত্র; যিনি একজন বাঙালি বিজ্ঞানী। গল্পে চরিত্রটির পুরোনাম ত্রিলোকেশ্বর শংকু; যিনি পেশায় একজন আবিষ্কারক।

পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখকদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য অদ্রীশ বর্ধন। আর, তারপর পশ্চিমবঙ্গের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখকদের মধ্যে আরও উল্লেখযোগ্য রয়েছেন হেমেন্দ্র কুমার রায়, লীলা মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনিল গাঙ্গুলী, অনীশ দেব, সিদ্ধার্থ ঘোষ, বিশ্বজিৎ গাঙ্গুলি, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখ।

এরপর পূর্ববাংলায় সর্প্রবথমে ১৯০৫ বেগম রকেয়া লেখেন “সুলতানার স্বপ্ন“। ১৯০৫ সালে মাদ্রাজের দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন- এ উপন্যাসিকাটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। এটি প্রথম মতিচূর ২য় খণ্ডে ” সুলতানার স্বপ্ন ” নামে বাংলায় প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। এরপর কাজী আব্দুল হালিম লেখেন ” মহাশূন্যের কান্না ” । ‘ মহাশূন্যের কান্না ‘ হল প্রথম পূর্ব বাংলার আধুনিক কল্প-বিজ্ঞান উপন্যাস।

বাংলা সাহিত্যে কল্প-বিজ্ঞান বৃত্তান্ত

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কল্প- বিজ্ঞান সাহিত্য

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, পূর্ব বাংলার বাংলা সাহিত্যে কল্প- বিজ্ঞান সাহিত্যের হাল ধরেন হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল। যদিও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় প্রথম কল্প-বিজ্ঞান সাহিত্য রচনা করেন হুমায়ন আহমেদ ” তোমাদের জন্য ভালোবাসা “; এবং এটি ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। এটি প্রথম বাংলাদেশী বাংলা সাহিত্যে পুর্নাঙ্গ বিজ্ঞান কথাসাহিত্য উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা কিছু বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনী হল, ইরিনা, অনন্ত নক্ষত্র বীথি, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, কুহক, নি, ফিহা সমীকরণ, শূন্য, ওমেগা পয়েন্ট, ইত্যাদি।

আর, তাঁর পরবর্তী সময়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল আরও অনেক কল্প বিজ্ঞান সাহিত্য রচনা করেন। এবং তিনি অর্ধ- শতাধিক বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনি লিখেছেন এবং তা ১৯৭৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তাই, মূলত মুহাম্মদ জাফর ইকবালকেই বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখা ও জনপ্রিয়করণের পথিকৃৎ হিসেবেই গণ্য করা হয়।

তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনির উপন্যাস ” কপোট্রনিক সুখ দুঃখ ” প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ” বিচিত্রা ”- তে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে।

বর্তমান বাংলা সাহিত্যে কল্প-বিজ্ঞানের অবস্থা

বর্তমান বাংলা সাহিত্যে কল্প-বিজ্ঞানের বেশ প্রসার ঘটেছে। এখন অনেক নতুন যুবক লেখকরা বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্প- কাহিনী লেখার দিকেই বেশি ঝোক দিয়েছে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সফল ও ধারাবাহিক কল্প-বিজ্ঞান রচয়িতা হলেন অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী।

এবং, বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যে বর্তমান যারা বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনি লেখায় যারা নিজেদের নিয়জিত রেখছেন প্রথমে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, মোশতাক আহমেদ, রুশদী শামস, আসিফ মেহ্‌দী, নাসিম সাহনিক, মোস্তফা তানিম, দীপেন ভট্টাচার্য , মির্জা গোলাম হোসেন, প্রমুখ।

এছাড়াও আরও অনেক তরুণ লেখক আছেন, যারা তাদের লেখা জীবনের শুরু করতে চাচ্ছেন বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনী লিখে। তাই বলা যায়, বর্তমান সময়ের ধারা যদি প্রবাহিত হতে থাকে, তবে আগামি ২১ শতাব্দীর মাঝামাঝি অংশে বাংলা সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনীর সমৃদ্ধি বাড়বে।

আশা করি ভালো লেগেছে, যারা এই নিবন্ধটি পড়েছেন। নিবন্ধটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। যদি এমন আরও নিবন্ধ পড়তে চান, তবে আরও পড়তে পারেন বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্প বৃত্তান্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *