বাংলা কবিতার আবৃত্তি সাহিত্য, বাংলা কবিতা সাহিত্যের একটি অপরিহার্য অংশ। আবৃত্তির মাধ্যমে একজন কবিতার ধারা-বহতা এবং কবির নৌকাকে একি স্রোতে নিয়ে এসে সেখানে ভাসতে পারেন। আবৃত্তি শব্দের মাধ্যমে সাধারণ অর্থে বারংবার পাঠ করাকে বোঝায়। আর যখন কবিতা আবৃত্তি হয়; তখন সাধারণ অর্থ ছাড়িয়ে অন্ন্য একটি ব্যাপক অর্থ লাভ করে। এই নিবন্ধটিতে চেষ্টা করবো বাংলা কবিতার আবৃত্তি সাহিত্য নিয়ে যতটা সম্ভব বিস্তৃত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
চেষ্টা করবো; আবৃত্তি সাহিত্য, আবৃত্তি সাহিত্যের ইতিহাস এবং বাংলা কবিতার আবৃত্তি সাহিত্য নিয়ে নিজস্ব অনুভব- অনুধাবন লিপিবদ্ধ করার। আশা করি পুরো নিবন্ধ আপনি পরবেন।
আবৃত্তি ও আবৃত্তির ইতিহাস
আবৃত্তি বাংলা শব্দ; এবং এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Recitation. যদিও শব্দ দুটি প্রতিশব্দ, তারপরও ভাষা আর ভাব- প্রকাশের ভিন্নতার কারণে বাপক অর্থে বাংলা আবৃত্তি আর ইংরেজি Recitation শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক। ইংরেজি Recitation- শব্দটি বাপক অর্থেও প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকতা পেরিয়ে খুব বেশি দূর যায় না।
অথচ, বাংলা ভাষার আবৃত্তি শব্দটি প্রতিষ্ঠান, প্রাতিষ্ঠানিকতা পেরিয়ে ব্যাপকতায় চলে আসে সবার অন্তরে। যারা বাংলা সাহিত্য চর্চা করেন, বাংলা কবিতা পড়তে ভালোবাসেন; তাদের মনে কবিতা আবৃত্তির জন্য এটি আলাদা প্রকোষ্ঠ রয়েছে যেখানে তারা তাদের এই কবিতা আবৃত্তির প্রতি ভালোবাসা নিজস্ব ভাবে লালন করেন সারাজীবন।
কবির কবিতার অনুভবের অবমুক্তি হয় সেই কবিতার আবৃত্তি দিয়ে। আর, তাই আবৃত্তিকে বলা হয় ” সর্ব শাসত্রানাং বোধাদপি গরীয়সী ” অর্থাৎ, ” সকল শাস্ত্রের মধ্যে বোধ অপেক্ষা আবৃত্তি শ্রেষ্ঠতর “। যা দ্বারা আরও বোঝানো যায়, যেকোনো শাস্ত্র পাঠের সময় তাকে আগে আবৃত্তি করো, যা সেই পঠিত শাস্ত্রের একটি রুপ মূর্তি তৈরি করবে। যার ফলে সেই শাস্ত্রের প্রতি বোধের উৎপত্তি আরও স্পষ্ট হবে।
যদি ফিরে যাই, আজ থেকে ৩০০০ বছর আগে; সেকালে শব্দের বুৎপত্তি গত অর্থ দাড়ায় ” বারংবার পাঠ “। এবং বৈদিক যুগের কবিরা তাদের কবিতা বা সাহিত্য সংরক্ষণ করতেন আবৃত্তির মাধ্যমে। সেকালে লেখে রাখার ব্যবস্থা ছিল না ভারতবর্ষে। আর, তারা সাহিত্য রচনা এবং চর্চা করতেন সভা করে। সেই সভার সবাই সেই কবিতাকে আবৃত্তির মাধ্যমেই মনে ধারণ করে রাখতেন এবং তা পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছাতেন।
এছাড়াও, পবিত্র কোরআনে সুরা মুযযাম্মিলে আছে, “ও রাত্তিলিল কুরানা তারতিলা ” অর্থাৎ, তোমরা তারতিলের সাথে কোরআন পাঠ করো বা আবৃত্তি সহকারে কোরআন পাঠ করো। এখানে ” তরতিল ” শব্দের অর্থ আবৃত্তি।
আবৃত্তির সংজ্ঞা ও উপাদান সম্বন্ধীয় আলোচনা
আবৃত্তি বিষয়টি বেশ জটিল; তাই একে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে বেশ বেগ পেতে হয়। এক্ষেত্রে সাধারণ ধারনায় বলা যায়, আবৃত্তি হল সাহিত্য কৃতির কোন অংশ, তা কবিতা কিংবা কোন গদ্য হতে কিছু অংশ শ্রোতার সম্মুখে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে প্রকাশ এবং উপস্থাপনের একটি শিল্প। আবার যদি বলি তবে দাঁড়ায়,
আবৃত্তির সংজ্ঞাঃ কোন কবিতা বা গদ্যের সামগ্রিক রূপ কে কণ্ঠস্বরে যথাযথ প্রয়োগ ও শব্দ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রমিত উচ্চারণ শুদ্ধ ও অক্ষুণ্ণ রেখে সেই বিষয়ে ধারণকৃত অনুভুতি,গতি, বিরাম, ছন্দ, আবেগ, ভাব ইত্যাদির সমন্বিত ও ব্যঞ্জনার প্রকাশই আবৃত্তি।
এইবার আসি আবৃত্তির উপাদানের আলচনায়। যেকোনো বিষয় আবৃত্তি করতে গেলে, সেক্ষেত্রে যেই বিষয়গুলো লক্ষণীয়; তাদেরকেই আবৃত্তির উপাদান বলা যায়। এক্ষেত্রে
- বিষয়বস্তু (কবিতা, গল্প, গল্পাংশ, সাহিত্য মান সমৃদ্ধ চিঠি, প্রবন্ধ, নাট্যাংশ, বিখ্যাত কোন ভাষণ ইত্যাদি)
- প্রমিত উচ্চারণ
- পাঠের গতি
- স্বচ্ছতা
- শ্বাসাঘাত
- স্বর প্রক্ষেপণ
- গড় গতি
- বিরতি
- ভাব, অনুভূতি, আবেগ
- অণুরণন
- স্বর বৈচিত্র্য
- স্বর বর্ণভেদ
- ধ্বনি
- ছন্দ
এই সকল লক্ষণীয় বিষয় গুলোকে আবৃত্তির এক-একটি উপাদান বলা যায়।
বাংলা কবিতার আবৃত্তি সাহিত্য
পুরো বিশ্বজুড়ে এই বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র বাংলাদেশ, কলকাতা ও জাপানে আবৃত্তির চর্চা করা হয়। অর্থাৎ, বলা যায় এই দুই ভাষা সাহিত্যেই শুধুমাত্র আবৃত্তি সাহিত্যের চর্চা হয়। এক্ষেত্রে অনেকের কাছে “আবৃত্তি সাহিত্য” কথাটা শুনে হতভম্বকর মনে হতে পারে! আসলে খুব ভালভাবে অনুধাবন করলে এই বিষয়টি লক্ষ্য করা যাবে যে, বাংলা সাহিত্যের বা পৃথিবীর যেকোনো সাহিত্যের আদি সংরক্ষণ পদ্ধতি ছিল আবৃত্তি।
যার কারণেই বোধ হয় পূর্বের সাহিত্যে আজকের মতো গদ্যের প্রচলন ছিল না। কারণ, কোন ঘটনা পঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মনে রাখা সহজ নয়; যদিনা তাতে মন- মাতানো কিংবা মনে আঁচড় কাটার মতো কোন উপাদান থাকে। তাই, হয়তো সেই সময় মানুষ তখন গল্প বা কোন কাহিনীর সাথে বিভিন্ন ছন্দ লাগিয়ে তাকে আরও রস-আস্বাদন দিত। ফলে সেই ছন্দগুলো বেশ কিছু বার আবৃত্তির পর পুরো ঘটনা বা কাহিনিটা মনে রাখা সম্ভব হতো।
আর, এইভাবেই ছোট ছোট সমাজবদ্ধ মানুষেরা তাদের জীবনাচরণ সাহিত্য হিসেবে গদ্যের বদলে মহাকাব্যে প্রকাশ করতেন। পরবর্তীতে লিপি আবিষ্কার হয়ার পর বিভিন্ন চিহ্ন দিয়ে তা প্রকাশ করা হতো। তারপর এখনও ভাষায় জ্যোতি চিহ্নের ব্যবহার দেখা যায়। যা শুধু বক্তব্যের থামা-চলাই নয় কোন বক্তব্যের বাচন ভঙ্গিও নির্দেশ করে।
তাই, বলা যায় বর্তমান সময়ে যে আবৃত্তি প্রচলিত আছে তার উৎপত্তির বিষয়টি আসলে বর্তমান সময়কার নয়। বরং, তা থেকেই লিখিত সাহিত্যের রূপ এসেছে পরবর্তীতে।
বর্তমান সময়ে বাংলা কবিতা আবৃত্তি সাহিত্য
যেখানে বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে; ব্লাকহোলের মুখে বাংলা সাহিত্য! সেখানে সেই লিখিত সাহিত্যের আবৃত্তি সাহিত্য কিভাবে ঠিক থাকতে পারে। এখানেও অলসতা আর দায়সারা মনোভাবে ডুবতে ধরেছে বাংলা কবিতা আবৃত্তি সাহিত্য। যদিও বর্তমানে আগের তুলনায় কবিতার আবৃত্তির চর্চা বেড়ে গেছে, তবে এই সময় প্রায় সবাই সাস্ত্র মুখস্ততেই বেশী জোড় দিয়েছে।
যার ফলে, বলা যায় কবিতাগুলো শুধু আবৃত্তির ভঙ্গিতে পঠিতই থেকে যায়; কিন্তু, তাতে কোন সত্তা থাকে না। আর তাছাড়াও, কবিতা আবৃত্তির বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে বলা যায়, প্রায় সবাই একই ধরনের বিষয়বস্তুর কবিতা আবৃত্তি করে। আর কেও যদি অন্য কোন বিষয়বস্তুরও কবিতা আবৃত্তি করে বা বিভিন্ন বিষয়বস্তুর কবিতা আবৃত্তি করে; তবেও সেগুলোর বাচনভঙ্গি প্রায় একি থাকে।
এবং, এইসব বিষয়গুলো সেই কবিতার আবেগগুলোকে মুক্তি দিতে পারে না। আর, প্রত্যেক বিষয়বস্তুর কবিতাতে একিই বাচনভঙ্গি; কবিতা আবৃত্তির সত্তাকে হত্যা করে। তাই, আমি বলবো প্রত্যেক আবৃত্তিকারের উচিত কবিতাতে বাঁচার এবং তার নিজের ভেতরে তার আবৃত্তি করা কবিতা গুলোকে বাচিয়ে রাখা.
এই পর্যন্তই থাক। আশা করি যারা পড়েছেন, তাদের ভালো লাগবে বা না লাগুক ভালো, তবু যা বলছি তা; অমৃত সত্য!
ধন্যবাদ
Kobita amar kub pochondoer
Kobita amar bison priyo