বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্প একটি নতুন সংযোজন। খুব বেশি সময় হয়নি বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের পদার্পণের। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা সাহিত্যে বাংলা ছোট গল্পের আবির্ভাব ঘটে। তবে এর ভাবধারা আরও এক শতক আগেই বিভিন্ন লেখকের লেখনিতে পাওয়া যায়। এই নিবন্ধটিতে চেষ্টা করবো বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলার।
বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্প খুব কম সময় ধরে বিরাজ করলেও; এক অসিম সত্তা ধরে রাখে এর মাঝে। তাই চেষ্টা করবো যতটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে সম্ভব বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের জগৎ নিয়ে কথা বলবো।
ছোটগল্প কি এবং বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের আবির্ভাব?
ছোট গল্প কি তা নিয়ে এক বাক্যে বা পরিপূর্ণ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ছোট গল্পের সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য আছে। তারপরও, বর্তমান সময় উপযোগী যেই ধারণা রয়েছে ছোট গল্পের সংজ্ঞা নিয়ে তা হল;
এডগার অ্যালান পো-এর মতে, যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোট গল্প বলে। অপরদিকে আরেকজন ইংরেজি লেখক হারবার্ট জর্জ ওয়েলস-র মতে ছোট গল্পগুলো ১০ থেকে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হাওয়া বাঞ্ছনীয়।
আর, বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মুখ খুললেন এই বলে যে;
ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্ত সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রু জল।
নাহি বর্ণনার ছটা,ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অকালের জীবনগুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল-
উক্ত কবিতাংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনারতরী’ কাব্যের যে ‘বর্ষাযাপন’ কবিতার অংশবিশেষ। বাংলা ছোট গল্প নিয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এটি বেশির ভাগ সময়ই উদ্ধৃত হয়। তারপরও এটি একটি ছোট গল্পের সকল গুনাগুন বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কথা বলে না। কারণ আরও বিভিন্ন ভাবে লেখা যায় ছোট গল্প বা নতুন ধরনের ছোট গল্পের সুচনাও হতে পারে।
আবার, রবীন্দ্রনাথের আরেক মতে ” শেষ হইয়াও হইল না শেষ ” এমন হতে হবে একটি ছোট গল্প কে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪) ও রাধারাণী (১৮৭৫) গল্পে প্রথম বাংলা ছোট গল্পের আভাস পাওয়া যায়। তারপর, পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের “মধুমতি” এবং সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ” দামিনী “এবং ” রামেশ্বরের অদৃষ্ট ” ইত্যাদি ছোট উপন্যাসধর্মী রচনা গুলোতেও ছোট গল্পের আভাস পাওয়া যায়।
তারপরই, একান্ত সতন্ত্র প্রতিভাস্পর্শে ছোটগল্পকে সমৃদ্ধ করেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর ” ভুত ও মানুষ”, ” মজার গল্প “, ” ডমরুচরিত ” ও ” মুক্তামালা ” গল্প গ্রন্থের মধ্যে ছোটগল্পের স্পষ্ট ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হয়; যদিও তাঁর রচনার কাহিনী বেশির ভাগই অদ্ভুত এবং উদ্ভট।
তারপর একে একে স্বর্ণকুমারী দেবী ও নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছোট গল্প লেখার চেষ্টা করেন এবং সেগুলো প্রাথমিক অর্থে ছোট গল্প হলেও প্রকৃত অর্থে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোট গল্পকার হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর প্রথম ছোট গল্প ” ভিখারিণী ” ১৮৭৪ সালে “ভারতী” পত্রিকাতে প্রকাশিত হলেও বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোট গল্প হল ” দেনা-পাওনা ” যা ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয় “ভারতী” পত্রিকাতেই।
তারপর বেশ কিছু সময়ের মধ্যেই শতাধিক ছোট গল্প রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক ছোটগল্পকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের ব্যঙ্গগল্পের ধারার তিনি এক বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার।
বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ছোট গল্পকার যারা
যদি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ছোট গল্পকাদের না চিনতে পারি তবে আমাদের বাংলা সাহিত্য পাঠ অনেক খানি অপূর্ণ থেকে যায়। আর বলা যায় আমাদের জ্ঞান অর্ধ-নগ্ন , অপুষ্ট থেকে যাবে। তাই চেষ্টা করবো যারা বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পকার হিসেবে সমাদৃত হয়ে আছেন তাদের নাম তুলে ধরার।
বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পকারদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য, তারা হলেন; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার, রাজশেখর বসু, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবুল মনসুর আহমদ, আবু রুশদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ফজলুল হক, সোমেন চন্দ, হাসান হাফিজুর রহজাব।
মাহবুব-উল আলম, আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দীন, শওকত ওসমান, সরদার জয়েনউদ্দীন, আবদুল হক, শামসুষ্টীনআবুল কালাম, আবু ইসহাক, আশরাফ সিদ্দিকী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, জহির রায়হান, লায়লা সামাদ, সুচরিত চৌধুরী, আবদুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হাসান আজিজুল হক, হাসনাত আবদুল হাই, রাহাত খান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বশীর আল হেলাল।
তারপর ষাটের দশকে যারা বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন; তারা হলেন হেলেনা খান, শহীদ আখন্দ, আবুবকর সিদ্দিক, মাহমুদুল হক, বুলবন ওসমান, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, হাজেরা নজরুল, আহমদ ছফা, ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ, ফরিদা হোসেন, কায়েস আহমেদ, হুমায়ুন আহমেদ, প্রমুখ।
এরপর আসলো, ১৯৭১- সালের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যাদের পদার্পণে বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের জগৎ আরও সমৃদ্ধ হয়েছে, তারা হলেন; মহসিন শস্ত্রপাণি, সাযযাদ কাদির, শান্তনু কায়সার, হরিপদ দত্ত, মুস্তাফা পান্না, ভাস্কর চৌধুরী, মঞ্জু সরকার, সুশান্ত মজুমদার, ইমদাদুল হক মিলন, আহমদ বশীর, ইসহাক খান, আহমদ মুসা, মঈনুল আহসান সাবের।
বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পে যারা নতুন ধারা এনেছেন
বাংলা সাহিত্যে ৭০- দশকের শেষের থেকে শুরু করে যাদের লেখনীর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের জগতে বিপ্লব এসেছে তাদের এই সাহিত্যের আধুনিকায়নে ভুমিকা অপরিসীম। বিষয়বস্তু, প্রকাশভঙ্গী ও ভাষার ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এমনকি তাদের ছোট গল্প গুলো বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের জগতে বৈপ্লবিক বলা যায়।
তারা হলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মহীবুল আজিজ, আবু হাসান শাহরিয়ার, অনামিকা হক লিলি, বিশ্বজিত চৌধুরী, ওয়াহিদ রেজা, আনিসুল হক, মনির জামান, সেলিম মোরশেদ, সেলিম মোজাহার, হুমায়ুন মালিক, শাহনাজ মুন্নী, রাজীব নূর, ফাহমিদুল হক, অদিতি ফাল্গুনি, আহসান ইকবাল, প্রশান্ত মৃধা, প্রমুখ লেখকরা ৭০ দশকের শেষ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ধারা পর্যন্ত সৃষ্টিশীল গল্পকার হিসেবে বেশি খ্যাত।
একজন বৈপ্লবিক ছোট গল্পকার হিসেবে মামুন হুসাইনের কথা এঁদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। ৮০- দশকের পর থেকে মানুন হুসাইন প্রচলিত বাংলা ছোট গল্পে নতুন ধারা যোগ করেন, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর গল্পগ্রন্থ ” শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি ” ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। এবং তাঁর গল্পগুলো বাস্তব ও কল্পজগতের সঙ্গে নিজস্ব দার্শনিক বোধের সাথে মিশে একাকার করে দিয়েছেন।
তাঁর গল্প গুলোতে কেবল মাত্র প্রচলিত ধারার বাতিক্রমই নয়, বরং; সেই সব গল্প গুলোতে বাংলাদেশের মানুষের জীবন আশ্চর্যরকম ভাবে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে আর স্পষ্ট বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।
বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের বর্তমান অবস্থা
বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলে বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। বর্তমানে যদিও প্রত্যেক বছর অনেক নতুন বই বের হচ্ছে; তারপরও দেখা যায় নতুন বিষয় না এসে বেশির ভাগ সময় গতানুগতিক বিষয়ই উঠে আসে। সেগুলোতে নতুন ধারার কিছু খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। আর, বলা যায় ২০০০ সালের পর থেকে বাংলা সাহিত্যে অধঃপতন শুরু হয়েছে।
এক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক ও আর্থ- সামাজিক অবস্থার প্রভাব অপরিহার্য। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে প্রত্যেক বার থেমে যায় আমাদের গতিপথ। বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক অস্থিতিশীলতা আমাদের মেধাকে টেনে ধরে পিছুটান। আর, যার ফলে আমারা হারিয়ে ফেলি নতুন নতুন ধারা। আর, পুরনো ধারায় জং ধরে যায় বার বার।
বাংলা সাহিত্যের এই অধঃপতনের ফলে গতানুগতিক বিষয়ের মধ্যেই আটকে থাকে আমাদের সাহিত্যের গতিপথ। আর, দিনে দিনে যখন সাহিত্যপাঠ শুধুমাত্র সহজ পাঠের উদ্দেশ্যে রচনা করা হচ্ছে; তখন ভাষার প্রয়োগিক দিক সীমিত থেকে সীমিত হয়ে যাচ্ছে। এমনকি দেখা যায়, বর্তমান সময়ের সাহিত্য পাঠে আমাদের কোন চায়ের দোকান বা ফেসবুকের পোস্টের থেকে বেশি কঠিন বা গভির কিছু মনে হয় না।
তো এক্ষেত্রে বলা যায়; দিন দিন ছোট হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের শব্দের অভিধান, আর তাতে শুধু চলিত ভাষাই বার বার পাক খায়। তো, এই হল বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্পের বর্তমান অবস্থা; যেখানে শুধু মাত্র চলতি ধারাই চলে যাচ্ছে নদীর স্রোতের মতো। তো এই ছিল বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্প বৃত্তান্ত।
আশা করি, যারা পড়েছেন; ভালো লেগেছে এই নিবন্ধটি।
Leave a Reply