বাংলা অনুবাদ সাহিত্য বৃত্তান্ত হলো আজকের নিবন্ধের মূল বিষয়। অর্থাৎ, বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের জন্ম বা সূত্রপাত, তারপর এর সমৃদ্ধি আর তারপর প্রচলিত ধারায় এসে বিকাশিত হওয়ার বৃত্তান্ত। আজকের এই নিবন্ধে শুরু করবো বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের একদম উৎপত্তি থেকে। তাহলে এর ধারা বিশ্লেষণ করা সহজ হবে। আর, প্রথমেই বলে রাখি বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের ধারা সুত্রপাত হয় বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের থেকে। মধ্যযুগে যখন এই ভূখণ্ডে নতুন শাসন শুরু হয় তখন অনুবাদের গুরুত্ব বাড়তে থাকে বিভিন্ন কারণে। আর মূলত সেই নতুম ভাষার শাসকদের প্রয়জনেই বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ প্রয়োজন হয়।
বাংলা অনুবাদ সাহিত্য-এর সুত্রপাত
বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্যের শুরু হয় ১২০৬ সালে বাংলায় তুর্কি শাসনের সূত্রপাত হয়। সেই সময় থেকেই বাংলা সাহিত্যে প্রয়োজীয় হয়ে ওঠে অনুবাদ। এদিকে পূর্ব বাংলা অঞ্চলের সাধারণ হিন্দুরা তুর্কি মুসলিম সাম্যে মুগ্ধ হয়ে শুরু করে মুসলিম হতে। আর তাদের নিজ ধর্মে বলবৎ রাখতে সর্ব প্রথমে সংস্কৃত মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করে কবীন্দ্র পরমেশ্বর।
১৫১৪-১৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলায় অনুদিত হয় মহাভারত; আর তাই তাকে কবিন্দ্র মহাভারতও বলা হয়।আর, এরপর লস্কর পরাগলের নির্দেশে রচিত মহাভারতকে বলা হয়, পরাগলী মহাভারত। তারপরও বাংলা অনুদিত মহাভারতের প্রধান কবি হলেন কবি কাশীরাম দাস, যিনি ১৬ শতকে আনুমানিক ১৬০২-১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তাঁর কাব্য রচনা করেন। অনুবাদটি ১৮০১- ০৩ শ্রীরামপুর প্রেস থেকে মুদ্রিত হয় এর এটি সকল বাংলায় অনুদিত মহাভারতের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
আর, মুসলমানদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চা বিকাশের সূত্রপাত হয় সুলতানি আমলে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে মূলত মুসলিম অনুবাদ সাহিত্যরে মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে রোম্যান্টিক ধারার সূত্রপাত হয়। যেখানে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৌদ্ধ- হিন্দু রচিত বাংলা সাহিত্যে দেবদেবীরা প্রধান, আর মানুষ অপ্রধান। সেখানে মুসলমান রচিত সাহিত্যে মানুষই প্রধান।
বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ যুগে, মুসলমান কবিরা হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ে রচনা করেছেন; চৌতিশা, জ্যোতিষ ও সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্যও তাঁরা রচনা করেছেন। তাদের রচিত সাহিত্যকে প্রধানত কাহিনীকাব্য, ধর্মীয় কাব্য, সংস্কৃতিবিষয়ক কাব্য, শোকগাথ, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় কাব্য, এবং সঙ্গীতশাস্ত্রীয় কাব্য মোট ৬টি ভাগে ভাগ করা যায়।
সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহের আমলে ( ১৩৮৯-১৪১০) রচিত ইউসুফ- জুলেখা কাব্যের রচয়িতা শাহ মুহম্মদ সগীর হল মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রাচীনতম। তাঁর রচিত সব পুঁথি চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা থেকে পাওয়া যায়। এরপরে গৌড় সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-৮১) সভাকবি জৈনুদ্দীন একটিমাত্র কাব্য ” রসুলবিজয় ” রচনা করে খ্যাতি লাভ করেছেন। কাব্যটির অংশবিশেষ ফারসি ভাষার গল্পাংশ থেকে নেয়া। ” বিজয় ” জাতীয় কাব্যধারা মধ্যযুগে খুব বেশি প্রাধান্য লাভ করার কারণে কাব্যটির সাথে “বিজয়” শব্দটি যুক্ত হয়েছে।
এরপর চলে আসেন ১৫ শতকের মধ্যবর্তী বিদ্যমান কবি মুজাম্মিল। তিনি মুলত নীতিশাস্ত্রবার্তা, সায়াৎনামা ও খঞ্জনচরিত এই তিনটি কাব্যের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। আরবি অনুবাদ “সায়াৎনামা” কাব্যটিতে সুফিবাদ স্থান পেয়েছে। এর আগের সময় ছিলেন চাঁদ কাজী; তিনি ছিলেম গৌড় সুলতান হুসেন শাহের ( ১৪৯৩-১৫১৯ ) নবদ্বীপের কাজী থাকাকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতের প্রচার ও প্রসার ঘটে এবং তিনি নানা কারণে বৈষ্ণব- ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন আর রচনা করেন বৈষ্ণব পদ।
তিনি সুলতান নাসিরুদ্দীন নসরৎ শাহের সময়ে আবির্ভূত ও সম্ভবত তাঁর রাজকর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত শেখ কবীর। নসিহৎনামা নামে একটি কাব্য এবং বৈষ্ণবীয় ঢঙে রচিত কয়েকটি পদের রচয়িতা আফজাল আলী সেযুগের অন্যতম কবি। সেগুলোতে কবিভাবের চেয়ে সরল ভাষায় ধর্মোপদেশ বেশি।
গোরক্ষবিজয়, গাজীবিজয়, সত্যপীর (১৫৭৫), জয়নবের চৌতিশা এবং রাগনামা এই পাঁচটি গ্রন্থের জন্য খ্যাতিমান হয়ে আছেন শেখ ফয়জুল্লাহ। তাঁর বচিত রাগনামাকে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য মনে করা হয়। এরপর আনুমানিক ১৫৬০-৭৫ সাল রচনাকালে ফারসি কবি জামীর রচিত লাইলী-মজনু কাব্যের ভাবানুবাদ করেন দৌলত উজীর বাহরাম খাঁ, যা তাঁর একমাত্র কাব্য লায়লী-মজনু। স্বচ্ছন্দ রচনা, কাব্যরসের মতো গুনে তা পরিপূর্ণ।
এরপর আনুমানিক ১৫৮৩-৮৭ সালের মধ্যে বকাওলী জাতীয় কাব্য ” মধুমালতী ” রচনা করে বিখ্যাত হন মুহাম্মদ কবীর। আর, এইভাবে চলেতে থাকে বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ যুগ। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য থেকে বাংলা ভাষায় যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন উপাদান।
বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা
বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা বেশ সচল। আর, বেশির ভাগ যেই ভাষার বইগুলো অনুদিত হচ্ছে বাংলায় তা মূলত ইংরেজি থেকে নেয়া। মধ্য-যুগে বাংলা সাহিত্যে সংস্কৃত, ফারসি আর আরবি ভাষা থেকে শুরু হয়েছিল। এরপর, বাংলায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলায় ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব বিস্তার।
শুরু হয় বিশদভাবে ইংরেজি সাহিত্য পাঠ। আর, সেইখান থেকে সৃষ্টি হয় ইংরেজি সাহিত্যের বিভিন্ন উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক বাংলায় অনুবাদ করার পিপাসা। সেই পিপাসা মিটাতে তখন শুরু ইংরেজি সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ। বাংলা সাহিত্যে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ষাইটয়ের পর সব চেয়ে বেশি অনুবাদ পাওয়া যায় ইংরেজি সাহিত্যের। ইংরেজি সাহিত্যের বিপুল পরিমাণ বই বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ হয়েছে। সেগুলো বেশির ভাগ সরাসরি অনুবাদ আর বেশ কিছু ভাবানুবাদ।
তারপর আর যেই ভাষা সাহিত্য গুলোর উপাদান বাংলা ভাষায় অনুবাদ যোগ হয়েছে সেগুলো হল, রাশিয়ান, জার্মান, ফরাসি, জাপানি, স্পেনিশ ইত্যাদি। বেশির ভাগ সময় রাশিয়ান ও জার্মান সাহিত্য মূলত বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা রাজনৈতিক কারণে।
তো এই ছিল বাংলা অনুবাদ সাহিত্য বৃত্তান্ত; নিবন্ধটিতে চেষ্টা করেছি বাংলা অনুবাদ সম্পর্কে আপনাদের মনে নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়ার। যাতে করে আরও পরিমানে বিকাশ হয় আমাদের বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ রীতির ধারা। আপনি চাইলে আমাদের ওয়েবসাইটে বাংলা সাহিত্যের আরও বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে পড়তে পারেন, বাংলা কবিতার আবৃত্তি সাহিত্য
Leave a Reply