April 18, 2024
পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বই রিভিউ

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বই রিভিউ

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বই রিভিউ আজকের নিবন্ধের মূল বিষয়। “পথের পাঁচালী” একটি অনন্য উপন্যাস বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর। তার, অকৃত্রিম হাতের লেখনী একটি সাধারণ গ্রামের দুই ভাই-বোনের বেড়ে ওঠার সাধারণ চিত্র অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে। সেই অসাধারণ ভাবের কারণে প্রথমে উপন্যাসটি আমাদের কাছে সমাদৃত হয়ে আছে আর এই উপন্যাসের কারণে আমাদের কাছে অমর হয়ে আছেন বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বই রিভিউ করার আগে উপন্যাসটি সম্পর্কে আগাম কিছু জানার দরকার, তাই প্রথমেই শুরু করবো উপন্যাসটি গঠন, প্রকাশনা ও তার বিস্তৃতি নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন।

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বই রিভিউ

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসটি প্রথমে প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে বা বাংলা ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ। “পথের পাঁচালী” উপন্যাসটি মোট ৩টি খণ্ডে বিভক্ত ও এর মোট ৩৫টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত।

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বই রিভিউ

প্রথম খণ্ডঃ বল্লালী বালাই (পরিচ্ছেদ ১-৬ পর্যন্ত) প্রথম খণ্ডে বলা হয়েছে ইন্দির ঠাকরূণের বর্ণনা।

দ্বিতীয় খণ্ডঃ আম-আঁটির ভেঁপু (পরিচ্ছেদ ৭- ২৯ পর্যন্ত ) দ্বিতীয় খণ্ডে বলা হয়েছে অপু আর দুর্গার একসাথে বেড়ে ওঠা, তাদের চঞ্চল শৈশব, দুর্গার অকাল মৃত্যু, অপুর সপরিবারে কাশীযাত্রা চিত্রিত হয়েছে।

তৃতীয় খণ্ডঃ অক্রূর সংবাদ (পরিচ্ছেদ ৩০-৩৫ পর্যন্ত) অপুদের কাশীজীবন, সেখে বসবাস কালে হরিহরের মৃত্যু, সর্বজয়ার কাজের জন্য কাশীত্যাগ এবং পরিশেষে নিশ্চিন্দিপুরে ফিরে আসার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

আর, এই তিনটিতেই শেষ হয়েছে পথের পাঁচালী। তবে এখানেই শেষ নয় অপুর চলার পথ; অপু চরিত্রকে ঘিরে বিভূতিভুষণ  লিখেছেন তিনটি পুরনাঙ্গ উপন্যাস। একটি হল পথের পাঁচালী তারপর অপরাজিত আর তারপর অপুর চরিত্রকে ঘিরে তার সর্বশেষ উপন্যাস হল অপুর সংসার।  আর এই তিনটি উপন্যাসই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে করেছে আমাদের কাছে অমর।

আর তার উপন্যাসগুলোর চরিত্র গুলো যেন আরও বেশি করে জীবন্ত করেছে সত্যজিৎ রায়ের এই তিনটি উপন্যাসকে ঘিরে ৩টি কালজয়ি বাংলা সিনেমা। তাদের নামও একই রাখা আছে। প্রথমে সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী” মুক্তি পেয়েছে ১৯৫৫ সালে, এরপর অপরাজিত মুক্তি পেয়েছে ১৯৫৬ সালে আর তারপর মুক্তি পায় অপুর সংসার ১৯৫৯ সালে।

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ” পথের পাঁচালী ” উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন যখন তিনি অধুনা বিহারের ভাগলপুরে বসবাস করতেন। সেই সময় তিনি ভাগলপুর জেলার জঙ্গলমহলে ঘুরতেন জঙ্গল লিজ দেয়ার কাজের জন্য আর তিনি সেখানে খেলাত ঘোষ এস্টেটের ম্যানেজারের পদে কর্মরত ছিলেন।

১৯২৫ সালে তিনি যখন ভাগলপুরের ” বড়বাসা ” তে থাকতেন; সেই সময় এপ্রিল মাসে তিনি “পথের পাঁচালী” রচনার কাজে হাত দেন আর তখনও তিনি উপন্যাসের “দুর্গা” চরিত্রের কথা ভাবেননি। ভাগলপুরে একদিন বিকালে এক দেহাতি গ্রাম্য কিশরীকে দেখতে পান তিনি, তার মাথায় তেলহীন রুক্ষ চুল হাওয়ায় উড়ছিল। তখনই তার মাথায় দুর্গা চরিত্রের কল্পনা করেন; আর নতুন করে লেখা শুরু করেন।

এরপর, তিনি এপ্রিল মাসেরই ২৬ তারিখে উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপির কাজ করেন এবং তা প্রেরণ করেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিকপত্র বিচিত্রায় প্রকাশের জন্য; আর পত্রিকাটির দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা থেকে উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে ( ১৯২৮-২৯)। আর জানা যায় সেই সময় পত্রিকাটিতে ধারাবাহিক ভাবে আরও প্রকাশিত হচ্ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগাযোগ ( ১৯২৭-২৮) উপন্যাসটি।

এর কিছু পরেই ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সজনীকান্ত দাস কর্তৃক রঞ্জন প্রকাশনালয় থেকে “পথের পাঁচালী” গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কাহিনী সংক্ষেপ

একজন অতি সাধারণ ব্রাহ্মণ হরিহর রায় ও তার স্ত্রী সর্বজয়া আর শিশু কন্যা দুর্গাকে নিয়ে নিশিন্দিপুর গ্রামে থাকেন। তাদের সাথে আরও থাকতেন ইন্দিরা ঠাকুর, তিনি একজন বৃদ্ধা মহিলা এবং তার দেখাশোনার কেউ আর আশ্রয় ভিটা না থাকায় তিনি আশ্রয় নেন হরিহরের বাড়িতে। তিনি হরিহরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন দূর সম্পর্কের আত্মীয় সূত্রে। তাঁর কিছুদিন পরই সর্বজয়ার একটি ছেলে সন্তান হয়।

কিন্তু, সর্বজয়া বৃদ্ধাকে পছন্দ করতেন না এবং তাকে হিংসা করতেন। সর্বজয়া ভাবতেন তার কন্যা দুর্গা, ইন্দিরা ঠাকুরকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। তাই, সামান্য একটি কারণে বৃদ্ধাকে বের করে দেয়া হয় তার কুঁড়েঘর থেকে; আর অসহায় বৃদ্ধাটি তার মৃত্যুর মুহূর্তে যখন আশ্রয়ের জন্য অনুরোধ করে, কিন্তু সর্বজয়া তাকে কোনরকম আশ্রয় দিতে নারাজি হয়।

শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা ঠাকুরের নির্মম মৃত্যু হয় চালের গুদামে। এর চার-পাঁচ বছর পর; সর্বজয়ার ছেলে অপু প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি কৌতুহলি হতে থাকে আর সংবেদনশীল হতে থাকে। দুর্গা আর অপু বেশির ভাগ সময় জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, আদিবাসী খেলায় অংশগ্রহন  আর চুরি করে ফুল ও ফল পারার মতো দুঃসাহসিক কাজের জন্য বাইরে ঘুরে ঘুরে বেড়াত।

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বই রিভিউ

এরপর অপু তার গ্রামের একটি পাঠশালায় ভর্তি হয়, আর সেখানে মূলত গ্রামের বেশ কিছু প্রবীণরা জড়ো হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতো। এরপর, হরিহর একদিন অপুকে সাথে নিয়ে গেল তার এক মক্কেলের বাড়িতে আর সেখানে যাওয়ায়; অপু প্রথম দেখতে পায় বাইরের জগতের ঝলক আর তার মন আনন্দে আর উত্তেজনায় ভরে উঠেছিল।

এছাড়াও একচেটিয়া গ্রামীণ জীবনের প্রবাহে বৈচিত্র্য আনে গ্রাম্য উৎসব, মেলা, এবং যাত্রা ইত্যাদি। এরপর, হঠাৎ জলোচ্ছ্বাসের মতো সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে মারা যায় অস্থির চিত্তের নিরীহ এক শিশু নারীসত্তা দুর্গা। একা হয়ে যায় অপু, হয়ে পড়ে সঙ্গীহীন। জীবিকা অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে হরিহর দীর্ঘ সময়ের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যায় আর সংগ্রাম করতে থাকে।

তারপর, একদিন বাড়ী ফিরে হরিহর সিদ্ধান্ত নিলো সে শহরের দিকে যাবে সপরিবারে গমন করে নতুন জীবিকা করবে। তাই, তারা সব গোছগাছ করে রওানা হল ষ্টেশনের দিকে। এরপর কলকাতার ট্রেন-এ করে যাওয়ার সময় তারা ফেলে গেল তাদের জীবনে নিশ্চিন্দিপুরের সব দুঃখ আর সুখের স্মৃতি।

তো এই ছিল পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের কাহিনী সংক্ষেপ।

পথের পাঁচালী-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠ পরবর্তী পর্যালোচনা

পথের পাঁচালী উপন্যাসটি পড়ার পর একজন মানুষের জীবনের বিভিন্ন অজ্ঞাত মোড় সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। তার তার সাথে আরও জানা যায় মানুষের জীবনের বহতার ধারা; শত প্রতিকুলতা, বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে মানিয়ে চলতে হয় একজন মানুষকে জীবনের চাহিদায়। সেখানে অনেক সময় পিছু ফিরে তাকানোর সময় বা ইচ্ছা মানুষের কোনটাই নাও থাকতে পাড়ে। মানুষ তার জীবনে ভুলও করে আর সেই ভুলের মাশুল তৎক্ষণাৎ না দিতে হলেও; তার ভুলটার কারণে হয়তো পরবর্তী সময়ে তাকে অনেক কিছু খওয়াতে হতে পারে।

“পথের পাঁচালী” উপন্যাসটি হরিহরের কলকাতায় গমনে শেষ হলেও তা আসলে সেখানে শেষ হয়নি; যেই উৎসুক শিশু চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছিল পরবর্তীতে সেই অপুকেই ঘিরে শেষ হয়েছে এই পাঁচালী কাঁথাটি।

তো এই ছিল মুলত নিবন্ধটির মূল উদ্দেশ্য। যদি এমন আরও বই বা উপন্যাস রিভিউ পড়তে চান আপনি আরও পড়তে পারেন মরণ বিলাস-আহমদ ছফা এর বই রিভিউ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *