April 16, 2024
দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বই রিভিউ

দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বই রিভিউ

দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বই রিভিউ এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। যারা বাংলা উপন্যাস পড়েছেন অথচ দেবদাসের নাম শোনেননি; তাঁরা বাংলা সাহিত্য পাঠকই নন। “দেবদাস” বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের একটি প্রণয়ধর্মী উপন্যাস। এটিতে স্থান পেয়েছে তৎকালীন সময়ে বঙ্গীয় উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজের মধ্যে বৈষম্য। আর, সেখানে আলোচিত হয়েছে এক মদ্যপ বিরহীর জীবন।

এই নিবন্ধের মূল বিষয় দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বই রিভিউ। তাই, চেষ্টা করবো যতটা সম্ভব সরল ভাবে উপন্যাস পড়ার পরের পর্যালোচনা ব্যাখ্যা করার। আশা করি, শেষ পর্যন্ত পড়তে পারবেন।

দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বই রিভিউ

দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বই রিভিউটি জানতে হলে প্রথমে দেবদাস উপন্যাসের সম্পর্কে একটি আগাম ধারণা তৈরি করা প্রয়োজন। এবং এক্ষেত্রে উপন্যাসটি লেখা ও প্রকাশের সময়; সমকালীন সামাজিক ও লেখকের সম্বন্ধে জানা দরকার। তাছাড়া পুরো রিভিউটাকে একটা বিশ্রী নিবন্ধও মনে হতে পাড়ে!

কারণ; নিবন্ধও লেখার মূল উদ্দেশ্য হল পাঠকদের একটি সুবিন্যাসকৃত তথ্য দেয়া।দেবদাস- উপন্যাসটি শরৎচন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর একটি; এমনকি বলা যায় জনপ্রিয়তার দিক থেকে তার অন্যান্য উপন্যাসকেও ছাড়িয়ে যায়।

দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনাকাল, প্রকাশ, জন্মকথা

প্রথমেই বলে রাখি “দেবদাস” শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর সাহিত্যজিবনের প্রথম দিকের একটি প্রনয়ধর্মী উপন্যাস। শরৎচন্দ্র তার এই উপন্যাসটি লেখা শেষ করেছিলেন ১৯০০ সালে; অথচ উপন্যাসটি তিনি প্রকাশ করেছেন ১৯১৭ সালে। আর, এই মাঝে একটা প্রশ্ন হতেই পাড়ে; তবে কেন এই ১৭ বছর তিনি এই উপন্যাসটি প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছেন।

এর একটি উত্তর পাওয়া যায় তার বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্য কে লেখা চিঠিতে। সেখানে তার বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যও তাকে চিঠিতে জিজ্ঞাস করেছিলেন; তিনি কেন “দেবদাস” উপন্যাসটি ছাপাচ্ছেন না। সেই প্রশ্নের উত্তরে শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন ” ‘ওই বইটা একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা।” তাই বলা যায় এই ১৭ বছর লেখক দ্বিধায় ছিলেন তার এই উপন্যাসটি নিয়ে।

তবুও শেষ পর্যন্ত যে তার দ্বিধার সাথে যুদ্ধ করে তিনি তার উপন্যাসটি ছাপাতে পেড়েছেন; এর বেশি কিছু আর কিবা চাইতে পারি আমরা পাঠক হিসেবে। শরৎচন্দ্রের “দেবদাস” উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া ফেলে চারদিকে। উপন্যাসটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এবং, এই পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯ টি চলচ্চিত্র।

আর, উপন্যাসটির নায়ক দেবদাস এই উপমহাদেশের বিরহকাতর চিরায়ত প্রেমিকদের ধ্রুপদি নিদর্শন।

দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কাহিনী সংক্ষেপ

দেবদাস বা দেবদাস মুখার্জি বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৎকালীন ব্রাহ্মণ জমিদার বংশের একমাত্র সন্তান। আর, পারু বা পার্বতী এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তারা দুই পরিবার পাশাপাশি বাস করতো বাংলার তালসোনাপুর গ্রামে। যার কারণেই তাঁদের ভেতরে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক এবং একজন অপরকে ” পারু ” ও ” দেবদা ” বলে ডাকে। স্কুলে পড়া থেকে শুরু করে পুকুরে মাছ ধরা পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাজই তারা একসঙ্গে করতো।

এমনকি পারু কোন কাজে ভুল করলে দেবদাস তাকে মারতোও। কিন্তু, তাঁদের এই সাজানো প্রজাপতির জীবন থাকলো না বেশিদিন। দেবদাসকে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হল কলকাতায়; আর সেখান থেকে কয়েক বছর পর ছুটির সময় ফিরে আসে দেবদাস; আর ফিরে এসে দেখে তার পারু বদলে গেছে; পার্বতী স্বপ্ন দেখে দেবদাসকে নিয়ে।

সে তাঁদের ছোটবেলার বন্ধুত্ব আর কৈশোরের গোপন প্রেমকে বিবাহবন্ধনে পরিস্ফুটিত করতে চায়। এবং, দেবদাসের বংশ পরম্পরা অনুযায়ী পার্বতীর বাবা- মাকে বিবাহের প্রস্তাব দিতে হবে দেবদাসের বাড়িতে। পার্বতীর কথায় তার মা দেবদাসের মা হরিমতির কাছে প্রস্তাব নিয়ে যায়। কিন্তু পার্বতীর পরিবার অ-জমিদার হওয়াতে দেবদাসের পরিবার তাতে বিশেষ উৎসাহ দেখায় না।

আর বহুকালের প্রথা অনুযায়ী পার্বতীর পরিবার থেকে ” পণ ” গ্রহনের প্রথা থাকায় দেবদাসের মা তাঁদের পরিবারকে ” বেচা-কেনা ছোটঘর ” মনে করে নিজে ও দেবদাসের বাবা নারায়ণ মুখার্জি কেও সেই যুক্তিতে সমর্থিত করেন; এবং দেবদাস ও পারুর বিয়ের সম্পর্কে জড়ানোকে নাকোচ করেন।  এবং তাতে পার্বতীর পিতা নীলকণ্ঠ চক্রবর্তী অপমানিত বোধ করেন ও পার্বতীর জন্য দেবদাসের চেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারে সাথে তাদের মেয়ে পার্বতীর বিবাহ ঠিক করেন।

দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বই রিভিউ

বিষয়টা পার্বতী জানার পর; ভাবে দেবদাস অন্তত তাকে গ্রহন করবে; সেই আশায় পার্বতী গৃহ ত্যাগ করে ছুটে যায় দেবদাসের কাছে; আর দেবদাসও মনস্থির করে তার বাবাকে বলার জন্য কিন্তু তার বাবা অরাজি হন। আর, সেই সিদ্ধান্তে বিভ্রান্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যায় কলকাতায়; পার্বতী যেতে চাইলেও তাকে ছেঁড়ে যায় দেবদাস।

আর, তারপর দেবদাস তাকে কলকাতায় তার কাছে যেতে বললেও সে আর যেতে  চায় না দেবদাসের কাছে। সেইদিনে দেবদাসের কাপুরুষতার কারণে পার্বতী তাকে ধিক্কার দেয়। এবং, সেই সময় সে দেবদাস থেকে একটি প্রতিজ্ঞা করে নেয়।  পারু দেবদাস কে বলে; ” তার মৃত্যুর আগে যেন দেবদাস কে একবার দেখতে পায় ” দেবদাস তার এই অনুরোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

বিয়ের প্রস্তুতি চলে পার্বতীর; তার বিয়ে হয় হাতিপোতা গ্রামের জমিদার ভুবন চৌধুরীর সাথে তার বিয়ে হয়। তাঁর পূর্বের স্ত্রী মারা গেছেন ও তার তিনজন সন্তান রয়ে গেছে। তারা আবার কেউ পারুর সমবয়সী; আবার কেও পারুর চেয়ে বড়।

দেবদাস চলে যায় কলকাতায়; সেখানে বন্ধুত্ব হয় চুনীলালের সাথে আর, চুনীলালের মাধ্যমে দেবদাসের সাথে পরিচয় হয় চন্দ্রমুখীর সাথে। সে একজন বাইজী; চন্দ্রমুখী দেবদাসের প্রেমে পড়ে কিন্তু, দেবদাস তাকে ঘ্রীনা করে। হতাশাগ্রস্থ হয়ে দেবদাস অত্যাধিক মদ্যপান শুরু করলে তখন দেবদাসের ক্রমশ ভেঙ্গে পড়া শরীর এর সেবা করে চন্দ্রমুখী।

দেবদাস চন্দ্রমুখীকে প্রতিনিয়ত পারুর কথা শোনাতো; তার সাথে পারুর তুলনা দিত। কিন্তু; তাতে বাড়তেই থাকে দেবদাসের দুঃখ। আর, দুঃখ বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে দেবদাসের মদ্যপান। তাই, দিন দিন মন্থর হতেই থাকে দেবদাসের শরীর।   তখন চন্দ্রমুখী বুঝতে পাড়ে তার ভেতরের মানুষের পতন ঘটেছে।

শেষ পর্যন্ত লক্ষহীন দেবদাস চন্দ্রমুখীর প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়। শীঘ্র আসন্য মৃত্যু টের পেয়ে দেবদাস পারুর কাছে চলে গেল সেই কথাটা রাখতে। দেবদাস গিয়ে হাজির হল হাতিপোতা জমিদার বাড়ির সামনে এক শিশির সিক্ত ভোর রাতে। কিন্তু, শরীরের শেষ অবনতিতে মৃত্যু হয় দেবদাসের। প্রবল মানসিক আর শারিরীক যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে মৃত্যু হয় তার।

পারু এই কথা শুনতে পেয়ে ছুতে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু; তাকে আর যেতে দেয়া হয় না। এমনকি পারুকে অতিক্রম করতে দেয়া হয় না বাড়ির চৌকাঠ।

দেবদাস-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পাঠ পরবর্তী পর্যালোচনা

” দেবদাস ” উপন্যাসের শেষ পরিণতিতে দেবদাস এর মৃত্যু যেন এই বঙ্গ দেশের সকল ব্যর্থ প্রেমের এক নির্মম পরিণতির ইঙ্গিত দেয়। এবং তাঁদের প্রেমের এই নির্মম পরিণতির জন্য দায়ি তৎকালীন সমাজে বৈষম্য। তাঁদের সময়কার আত্ন- অহংকারী চেতনা।

যার ফলে সম্পর্ক বা বন্ধনের বিষয়গুলো তাঁদের কাছে ছোট মনে হতে থাকে। আর, এই ভাবে এক সময় তাঁদের ভেতরের অহংকারে ধ্বংস হয় তারা। দেবদাস আর পারুর জীবনে এই নির্মম পরিণতি লেখক কেন লেখেছেন তাও একটা আলোচ্য বিষয়।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে খ্যাতনামা একজন ঔপন্যাসিক। তার লেখা উপন্যাসগুলো তৎকালীন সময়কার সামাজিক চিত্র স্পষ্টত তুলে ধরে। তাই, যখন শরৎচন্দ্রের এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়; তখনতার এই কাহিনিতে মুগ্ধ হয় তৎকালীন পাঠকরা। আর, বেশি কিছু বলার নেই। শুধু বলবো; যদি না পড়ে থাকেন; তবে পড়ে নিবেন বাংলা প্রণয়ধর্মী সাহিত্যের এই সামান্য সূক্ষ্ম নিদর্শন।

যদি এমন আরও নিবন্ধ পড়তে চান; তবে পড়তে পারেন আধুনিক বাংলা গানে প্রেম!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *