April 14, 2024
বাংলা গানের ইতিকথা

বাংলা গানের ইতিকথা

বাংলা গানের ইতিকথা বলেতে বাংলা গানের জন্ম, এর বেড়ে ওঠা এবং এর ধারা সম্পর্কে পূর্বালোচিত তথ্যের ভিত্তিতে পুনঃবিন্যাসকৃত একটি নিবন্ধ। এই নিবন্ধে চেষ্টা করবো বাংলা গান- এর ইতিহাস থেকে বয়ে আশা বর্তমান ধারা পর্যন্ত এবং চেষ্টা করবো, আলোচনা- সমালোচনা, ও এর ভবিষ্যৎ বিকাশে করণীয় কোন বিষয়বস্তু নিয়েও আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আশাকরি, শেষ পর্যন্ত পরবেন এই নিবন্ধটি।

প্রথমেই কোন বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তা উৎপত্তি নিয়ে আগে কথা বলা দরকার। তা না হলে পুরো আলোচনা অন্তঃসার শুন্য মনে হতে পারে। তাই প্রথমেই এই নিবন্ধটি শুরু করবো বাংলা গানের জন্মকথা নিয়ে। আর আগেই বলে রাখি, বাংলা গানের জন্ম; বাংলা ভাষার সাথেই।

বাংলা গানের ইতিকথা- বাংলা গানের জন্মকথা

বাংলা গানের জন্মকথা

বাংলা গানের জন্মকথা বলেতে বলা যায় ” কীভাবে বাংলা গান এলো? ” আসলে যদি একদম আদি উৎপত্তির কথা বলি তবে কোন সঠিক ইতিহাস বা দিন- তারিখ গননা করে বলা সম্ভব নয়। কারণ, লিখিত ভাষার আগেও হাজার হাজার বছর ধরে চলেছে মৌখিক ভাষা। সেখানে গানের ধারা তখন যা ছিল, তা থেকে এখনকার গানের বিষয়বস্তু আলাদা।

এমনকি যেখান থেকে বাংলা গানের ইতিহাসে ধরা হয়; সেই সময়কার আর এই সময়কার ধারার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে। একটা কথা বলে রাখা উচিত; গান আর সঙ্গীত দুটো একই মনে হলেও এর মধ্যে আবার বিস্তর পার্থক্য আছে। সঙ্গীত হল শাস্ত্রীয় রীতি মেনে সুর, তাল ও আলঙ্কারের এক নিবিষ্ট উপস্থাপনের মাধ্যমে গান গাওয়া। যদি শুধু গান বলা হয় তবে, সেটার ভেতর পরে সঙ্গীত, বাউল গান, পালাগান, ভাওয়াইয়া গান, আধুনিক গান ও বাংলা ব্যান্ড।

বাংলা গানের ইতিকথা বলতে গেলে বাংলার এই সবগুলো গানের ধারা নিয়ে কথা আসবেই। আর, বাংলা গানের ইতিকথায় বলা যায়, এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার যে সর্ব প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে হল চর্যাপদ। চর্যাপদ হল পুঁথিকাব্য; আর এই পুথিই হল বাংলা গানের প্রথম লিখিত নিদর্শন, আর চলতি ধারাতেও তাঁর একটা অনুভব পাওয়া যায়। আর, তাই যতদূর জানা গেছে; চর্যাপদ বাংলা গানের আদি নিদর্শন।

বাংলা গানের ইতিকথা

এইবার আসবো আমরা বাংলা গানের ইতিকথায়। বাংলা গানের এই ইতিকথায় আমরা বাংলা গানের ধারা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। আগেই জানলাম বাংলা গানের আদি নিদর্শন হল চর্যাপদ; যা আসলে পুঁথি কাব্য। এইসব পুথির পদকর্তাদের বলা হয় ” সিদ্ধাচার্য “। চর্যাপদে মোট ৫১টি পদ পাওয়া যায়। আরও, সহস্রাব্দি পর্যন্ত এই ধারার পুঁথি পাঠ চলার পর; শুরু হয় বাংলার প্রাচীন সংগীতকলা সংস্কৃত স্তোত্রসঙ্গীত প্রভাবিত বৈষ্ণব ধর্মগীতিগুলি। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কবি জয়দেব রচিত গীতিগোবিন্দম স্তোত্রসঙ্গীত জাতীয় সংগীত এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

এরপরে চলে আসে মধ্যযুগ; চলে আসে নবাব ও বারো ভূঁইয়া নামে খ্যাত শক্তিশালী ভূস্বামীবর্গ। তবে তাঁরা অত্যাচারী না হয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে এই প্রতিপালিত এই সংগীত ধারায় হিন্দু ও মুসলিম সাংগীতিক রীতির সাথে সমন্বয় করার চেষ্টা করেন। এবং তা লক্ষ্য করা যায় বাংলা সুফি গানে। প্রাচীন যুগের পর মধ্যযুগের বেশির ভাগ গানগুলো ধর্মীয় সংগীত।

রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গানে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেমচেতনার মধ্যে পার্থক্য দর্শিয়েছেন  বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, ও বলরামদাস প্রমুখ বৈষ্ণব পদকর্তাগণ মধ্যযুগের প্রথম অংশে। আর তারপরে রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ শাক্তপদাবলিকারগন তাঁদের গানে ঈশ্বরকে শুদ্ধ মাতৃরূপে বন্দনার কথা বলেছেন মধ্যযুগের শেষের অংশে।

আর বৈষ্ণব সংগীতে যখন জীবাত্মা- পরমাত্মাকেন্দ্রিক প্রেমভক্তির তত্ত্ব প্রচার করে, তখনই শাক্তগানে তন্ত্র ও শ্রদ্ধা মাতৃবন্দনার এক সম্মিলন গড়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮ শতাব্দী ও ১৯ শতাব্দীর দিকে বাংলা ভক্তি গানের সাথে আরও এক নতুন ধারা যোগ হয় বাউল গান। বাংলায় বাউল গান নিয়ে আসলো আধ্যাত্মবাদী চারণকবিরা। তাঁরা ঘুরে ঘুরে গান করতেন; তাঁদের গানে হিন্দু তান্ত্রিক কর্তাভজা ও ইসলামি সুফি দর্শনের উপাদান স্পষ্ট বিদ্যমান।

তাঁরা ঘুরে ঘুরে গাওয়া সেইসব গানে তাঁরা প্রচলিত ধর্মকেন্দ্রিক কুসংস্কার, ভেদাভেদ ও ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার কথা তুলে ধরতেন। বাউল গান-এর ধারার শ্রেষ্ঠ বাউল হলেন শ্রেষ্ঠ ফকির লালন সাঁই যদিও তিনি ১৯ শতকের বাউল। তাঁর পরে আরও বাউল ও সুফি গানের রীতিতে যারা স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁরা হলেন মধ্যযুগের হাসন রাজা, আধুনিক যুগের বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম ও বাউল-সম্রাট পূর্ণদাস বাউল৷

বাউল গানের অনেক আগেই থেকেই আরেকটি শাস্ত্রীয় গানের ধারা অব্যাহত ছিল বাংলা গানের ধারায়। ধারণা করা হয় প্রায় ১৩৭০ সালে মল্ল রাজদরবারে ” বিষ্ণুপুর ঘড়ানা ” নামের শাস্ত্রীয় সংগীতের সূত্রপাত ঘটেছিল। সমগ্র বাংলার একমাত্র শাস্ত্রীয় ঘরানা ও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের হিন্দুস্তানি ধারার ধ্রুপদ সংগীতের একটি ঘরানা। অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরে মল্ল রাজাদের আমলে উৎপত্তি লাভ করে। কিন্তু, মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের দমন-পীড়নের ফলে ১৮শ শতকেই এটি প্রথম বিশেষ মর্যাদা অর্জন করে।

এরপর বাংলাগানে নতুন মাত্রা যোগ হল; চলে আসলো রবীন্দ্র সংগীত। রবীন্দ্রসংগীতে গীতিকাগুলোতে বেশির ভাগ স্থান পেয়েছে প্রেম, তার থেকে পাওয়া ব্যাথায় বিরহ। তাঁর গানে- গিতীকায় মিলেছে ঈশ্বর ভক্তি যাতে পাওয়া গেছে দেবী বন্দনা আর কীর্তন। সঙ্গীতের বুৎপত্তি অনুসারে রবীন্দ্রসঙ্গীতে পাওয়া যায় পাশ্চাত্য সংগীত, বাংলা লোকসংগীত, কীর্তন, রামপ্রসাদী শ্যামাসংগীত, কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সংগীত।

বাংলা সাহিত্যের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বাংলা গানকে উপহার দিয়েছেন ২২৩২ টি গান। তাঁর এই সবগুলো গান স্থান পেয়েছে ” গীতবিতান ” নামক ২ খণ্ডের সংকলনে।

তাঁর সাথে সাথেই চলে আসলো, এক অশান্ত ধূমকেতু কিংবা পৃথিবীর সব আত্মার অশান্তি এক আত্মায় আছড়ে পড়া এক উল্কাপিণ্ড; নাম কাজী নজরুল ইসলাম । তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি; তাঁর গান গুলোকে বলা হয় নজরুলগীতি।  সীমিত সময়ে এক হাতে লিখেছেন ৫৬০০- টি গান। আর, পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় এক হাতে এত গান লেখা হয়নি; তবে তার সবগুলো সংকলনে সংরক্ষিত নেই। কারণ, তার অগোছালো, অতৃপ্ত ভবঘুরে জীবন।

কাজী নজরুলের  “নজরুলগীতি” ছাড়াও আরও যাদের গান পাওয়া যায় বাংলা ভাষায়, তাঁরা হলে রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু), অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং রজনীকান্ত সেনের গানও দুই বাংলায় সমান জনপ্রিয় সঙ্গীত।

এর সাথে আসে বাংলার উত্তরাঞ্চল এর নিজস্ব ধারার গান ভাওয়াইয়া। সেই গানে রয়েছে নিজস্ব সুর আর তাতে প্রতিফলিত হয়েছে বাংলার উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন। বাংলা গানের এই ধারাকে সবার সামনে এনেছেন আব্বাসউদ্দীন। তারপরে চলে আসলো বাংলায় আধুনিক গান, সেখানে নতুন রূপে, নতুন সাজে, নতুন সুরের ধাঁচে।

বাংলা আধুনিক গান যারা লিখেছেন এবং গেয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম শিল্পীরা হলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমার, রাহুল দেব বর্মন, অজয় ভট্টাচার্য, হিমাংশু দত্ত, সলিল চৌধুরী, হিরেন বসু, সুবোধ পুরকায়স্থ, প্রণব রায়, শৈলেন রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, কুমার শানু, শান, শ্রেয়া ঘোষাল, শ্যামল গুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল দত্ত, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, , শচীন দেব বর্মন, গীতা দত্ত, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

আর সবার শেষে বাংলা গানের ইতিকথায় যোগ হয় ব্যান্ড সঙ্গীত। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের আজম খানের ব্যান্ড উচ্চারণ এবং আখন্দ ভাতৃদ্বয়ের হাত ধরেই শুরু হয়। আর এর কিছু পরেই একে একে চলে আসে বাংলা গানে নতুন নতুন ব্যান্ড। ফীলিংস, এল আর বি, ওয়ারফেজ , মহীনের ঘোড়াগুলি, নগর বাউল, আর্ক, ফসিল্‌স ইত্যাদি। কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত জীবনমুখী গান নিয়ে মাতিয়ে তোলেন একক কণ্ঠে কবির সুমন, নচিকেতা আর অঞ্জন দত্ত।

বাংলা গানের ইতিকথার উপসংহার

তো এই ছিল বাংলা গানের আপাত ইতিকথা। যেখানে ইতিকথাটি শেষ করেছি বাংলা জীবনমুখী গানে। আর, এরপরে বনাগ্লা গানে লক্ষণীয় কোন পরিবর্তন তেমন আসেনি। তবে মিশ্র সংস্কৃতির সমন্বয়ে নতুন করে সাজানো হয়েছে বাংলা গান। সেখানে নতুন কোন গীতিকার প্রয়োজন হয়নি। শুধু পুরনো গীতিকা গুলোকে এককভাবে কিংবা বিভিন্ন গীতিকার মিশ্রণে নতুন আঙ্গিকে সুর ও তাল দেয়া হয়েছে।

আর, এক্ষেত্রে কথা বলতে গেলে বলা যায় নতুন আঙ্গিকের সুর-তালে পুরনো গান গুলো তাদের সরলতা আর কথার হৃদ্যতা হারাচ্ছে। আর যাই হোক, বাংলার সব গানেই ইউরোপীয় সুর বা বাদ্য লাগালেই তা অত্যাধুনিক হয় না। বরং, কথার মর্ম হারায়, সত্য হওয়া সত্ত্বেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *